মায়ের সঙ্গে কারাগারেই থাকবে শিশু মোহাম্মদ
কারাগারে বেড়ে উঠতে হবে ৬ মাসের শিশু মোহাম্মদকে। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মায়ের সঙ্গে কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। এদিন দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে জেলা জজ ও দায়রা জজ আদালতে শিশু আহমেদ (৩) হত্যা মামলায় কহিনুর বেগমকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এসময় কহিনুরের কোলেই ছিল মোহাম্মদ। ৬ মাস আগে কারাগারেই জন্ম হয়েছে তার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও আদালতে গিয়ে দেখা যায়, শিশু মোহাম্মদকে কোলে নিয়ে মা কহিনুর এজলাসের ভেতর বসা ছিলেন। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বিচারক শিশু আহমেদ হত্যার রায় দেন। এর কয়েক মিনিট পরই শিশু মোহাম্মদকে কোলে নিয়ে রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত কহিনুরের হাত ধরে বের করে আনে দুইজন নারী পুলিশ। তখন এজলাসের সামনে দাঁড়ানো লোকজন চেয়েছিল ফুটফুটে শিশুটির দিকে। শিশুটিও সবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হৃদয় বিদারক এ দৃশ্য সবার মনকে বিষণ্ন করে তুলেছে। সৎ ছেলেকে হত্যা করে নিজের গর্ভের সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে কারাগারে।
জেলা কারাগারের জেলার সর্বোত্তম দেওয়ান মোবাইল ফোনে বলেন, গর্ভবতী অবস্থায় হত্যা মামলায় কহিনুর কারাগারে আসেন। পরে তাকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় ৬ মাস আগে সেখানে তিনি সন্তান প্রসব করেন। পরে তাকে লক্ষ্মীপুর কারাগারে নিয়ে আসা হয়। আজ মামলার রায় দিয়েছে। ৬ বছর পর্যন্ত সে তার মায়ের সঙ্গে কারাগারেই থাকবে।
জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন জানান, রাগের মাথায় আসামি কহিনুর শিশু আহমেদের পেটে লাথি দিলে সে মারা যায়। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট থেকেই তিনি কারাগারে রয়েছেন। তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। পরে কারগারেই তিনি সন্তান জন্ম দেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম শিশু আহমেদ হত্যায় কহিনুরের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরে তাকে কারগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মোহাম্মদ যেহেতু দুধের শিশু, এতে তাকে দুগ্ধ পান ও লালন পালনের জন্য মায়ের সঙ্গে কারাগারে থাকতে হবে। এ কারণে মায়ের সঙ্গে তাকেও কারাগারে যেতে হয়েছে।
মামলার বাদী ও শিশু মোহাম্মদের বাবা মিরন হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, মোহাম্মদকে বাইরে রাখার জন্য আদালতসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দুধের শিশু হওয়ায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে আমাদের কাছে দেওয়ার বিধান নেই। এজন্য তাকে বাইরে রাখতে পারিনি।
দণ্ডপ্রাপ্ত কহিনুর রামগঞ্জ উপজেলার দরবেশপুর ইউনিয়নের উত্তর দরবেশপুর গ্রামের মোবারক হোসেন কুট্টির মেয়ে। মামলার বাদী মিরন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রায়চৌ গ্রামের হাবিব মিয়ার ছেলে। দণ্ডপ্রাপ্ত কহিনুর বাদী মিরনের দ্বিতীয় স্ত্রী।
মামলার এজাহার সূত্র জানায়, মিরন ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে চাকরি করেন। পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রথম স্ত্রী শারমিন আক্তারের সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। আহমেদ তার প্রথম সংসারের ছেলে। কিছুদিন পর মিরন রামগঞ্জের কহিনুরকে বিয়ে করে। শিশু আহমেদসহ দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি নিজ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
২০২২ সালের ২২ জুলাই স্ত্রী-সন্তানকে রেখে তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে চলে যান। ১০ আগস্ট আহমেদকে নিয়ে কহিনুর রামগঞ্জের দরবেশপুরে তার বাবার বাড়িতে যায়। সেখান থেকে ২৭ আগস্ট কহিনুর তার স্বামীর বাসায় আসেন। এরপর মিরনকে তিনি জানান আহমেদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একইদিন ঢাকা থেকে এসে বিভিন্নস্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তিনি ছেলেকে পাননি। এতে ২৮ আগস্ট হাজীগঞ্জ থানা পুলিশকে ঘটনাটি অবহিত করা হয়। পরদিন হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ বাসায় গিয়ে কহিনুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সত্যতা স্বীকার করেন। কহিনুর পুলিশকে জানান, ২৬ আগস্ট দিবাগত রাত ২টার দিকে পেটে লাথি দিলে আহমেদ মারা যায়। পরে দা দিয়ে খাটের নিচে গর্ত করে তার মরদেহ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। পরে রামগঞ্জ থানা পুলিশের সহযোগিতায় ২৯ আগস্ট বিকেলে দরবেশপুর এসে কহিনুরের বাবার বাড়ির শয়নকক্ষের খাটের নিচে পুঁতে রাখা আহমেদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একইদিন মিরন বাদী হয়ে কহিনুরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
একই বছর ৩০ অক্টোবর রামগঞ্জ থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাস আদালতে আসামি কহিনুরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত এ রায় দেন।
হাসান মাহমুদ শাকিল/এমএএস