এক যুগ ধরে শিকলবন্দি বাবা-মা হারা মেহনাজ
পড়াশোনাতে ছিলো মেধাবী, তাই ক্লাসে থাকতো সবার মধ্যমণি হয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে শেরপুরের কিশোরী মেহনাজ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে পরিণত হয় মানসিক রোগীতে। তার বর্তমান অবস্থার পেছনে দায়ী পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা আর উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারার আক্ষেপ।
অর্থসংকটে চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে শিকলবন্দি বাবা-মা হারা এই কিশোরী মেহনাজ। চিকিৎসকরা বলছেন, মেহনাজ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি হাসপাতালেই সম্ভব এই রোগের চিকিৎসা।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ব্রিজপাড় এলাকার প্রয়াত নূর মোস্তফা ও হাওয়া বেগম দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মেহনাজ। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তাকে ভাঙা ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে কোনো লাভ না হওয়ায় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আর নেয়নি পরিবার। পরবর্তীতে অবস্থার আরও অবনতি হলে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
জানা গেছে, সারাদিন কারো উপস্থিতি ছাড়াই একাই কথা বলে মেহনাজ। কেউ কাছে গেলে মারধর করে। শিকল খুলে দিলে বাড়ি থেকে বের হয়ে হারিয়ে যায়। এসব বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ একযুগ ধরে শিকলে বেঁধে রেখেছে তার পরিবার। ডান পায়ে দীর্ঘদিন ধরে শিকল বেঁধে রাখায় পচন ধরেছে পায়ে। এখন বাম পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঠাঁই হয়েছে অস্বাস্থ্যকর ভাঙা একটি ঘরে।
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর দরিদ্র বড় ভাই আর ভাবিই তার ভরসা। প্রতিদিন খাওয়া গোসল সবই করাতে হয় বড় ভাই হাসানকে। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি তার। দুই বছর ধরে সব চিকিৎসা বন্ধ হয়ে আছে অর্থ সংকটে।
নৈশপ্রহরী ও চা দোকানি দুই ভাইয়ের পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব না হওয়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন কাটাতে হচ্ছে মেহনাজকে। প্রতিবেশী ও স্বজনদের আশা, সরকার ও বিত্তবানরা এগিয়ে এলে সুস্থ হবেন মেহনাজ।
বড় ভাই হাসান মিয়া বলেন, বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায়, পাবনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোনো লাভ হয়নি। আমি নৈশপ্রহরীর চাকরি করে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতন পাই। আমার বড় ভাই চা বিক্রি করেন। আমাদের পক্ষে বোনের চিকিৎসা খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব। সমাজসেবা থেকে কিছু সহযোগিতা পেয়ে মেহনাজকে ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে। মাসের পর মাস তার পেছনে বাড়তি খরচ করতে হয়। কোনোভাবে যদি বোনটার সুচিকিৎসা করাতে পারতাম, আমরা খুবই উপকৃত হব।
প্রতিবেশী শাহরিয়ার কাজল বলেন, মেহনাজের পরিবার অনেক দরিদ্র। দুই ভাই নিজেদের পরিবারের ভরণ-পোষণ করতেই হিমশিম খান। এর উপর মেহনাজের জন্য প্রতিনিয়ত চিকিৎসার খরচ তাদের পক্ষে চালানো কঠিন। তাই সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসে একটি স্থায়ী সুচিকিৎসা করানো সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদী পরিচর্যা আর চিকিৎসায় মেহনাজ সুস্থ হতে পারে।
প্রতিবেশী আব্দুল মোমিন বলেন, শুরুর দিকে কিছুটা কম থাকলেও ধীরে ধীরে অসুস্থতা বাড়লে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন মেহনাজ। পরে তাকে শিকলে বেঁধে রাখে পরিবারটি। মেহনাজ কারণ ছাড়াই কখনও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেঁচি করতে থাকে আবার একা একাই কথা বলেন। মা-বাবা হারা মেহনাজের পাশে বিত্তবানদের সহযোগিতা খুব প্রয়োজন।
নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাহিদুল হক মনির। তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে তার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা এলে আমরা তাদের পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করি। তার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে মেহনাজের সুচিকিৎসা করানো সম্ভব।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক বাহাদুর শাহ মজুমদার বলেন, এটি একটি জটিল মানসিক রোগ। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পেলে এ রোগ সেরে ওঠে।
এদিকে সিজোফ্রেনিয়া নামের এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা একমাত্র মানসিক হাসপাতালেই সম্ভব। তাই দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজীব সাহা। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতাল থেকে সমাজসেবার মাধ্যমে তাকে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করা হয়। তার চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতাল প্রয়োজন। সুচিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তার কিছুটা উন্নতি করা সম্ভব। তবে দ্রুত চিকিৎসা করাতে পারলে উন্নতি হবে।
উবায়দুল হক/আরকে