সজলের বিচার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ক্লাস বর্জন
ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের প্রতিবাদে বগুড়ার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে (আইএইচটি) দ্বিতীয় দিনেও বিক্ষোভ চলছে। অধ্যক্ষকে অপসারণ ও সজল ঘোষের বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন করেছেন।
তবে সজলের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নানা অপকর্মের অভিযোগ তুললেও নীরব শিক্ষকেরা। আইএইচটির অধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষকদের দাবি, সজল ঘোষের কোনো অপরাধ তারা দেখেননি, জানেন না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধ্যক্ষের সরাসরি মদদে সজল ঘোষ কলেজে রামরাজত্ব চালিয়েছেন এতদিন। কলেজে অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতেন সজল। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলতেন। সর্বশেষ বনভোজনের নামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে থেকে ১১০০ টাকা করে চাঁদা তুলেছেন।
অভিযুক্ত সজল ঘোষ বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। বর্তমান তিনি কোনো পদে নেই। তিনি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার দক্ষিণ তিতপাড়ার মৃত সুমেন কুমার ঘোষের ছেলে। সজল ২০০৫ সালে ডিমলা রানী বৃন্দারানী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বগুড়ার বেসরকারি একটি মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করেন তিনি।
বুধবার দুপুরে কলেজে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবিতে ক্লাস বন্ধ রেখে ক্যাম্পাসে বসে আছেন। তারা অধ্যক্ষের কক্ষ তালা দিয়ে রেখেছেন। তাদের দাবিগুলো হলো- বহিরাগত সন্ত্রাসীকে আশ্রয় ও প্রশ্রয়দানকারী অধ্যক্ষ ডা. আমায়াত-উল-হাসিনের অপসারণ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ইভটিজিংকারী সজল ঘোষের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং সকল শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জাকিরুল ইসলাম বলেন, সজল ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে। সবাইকে অনেকভাবে অত্যাচার করেছে। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। আমি ২৪ ঘণ্টা তার সঙ্গে থেকেছি। সে হাত-পা টিপে নিতো, মাথা টিপে নিতো। দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিতাম। তার সব কাপড় পরিষ্কার করে দিতাম। একদিন তার লুঙ্গি পরিষ্কার করে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এ জন্য আমাকে দুইটা চড় মারে।
তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেটের নামে চার মাস ধরে সজল আমাদের কাছে ৪০০ টাকা করে নিয়েছে, কিন্তু ইন্টারনেট দিতে পারেনি। আমরা হোস্টেলে ১০৫ জন আছি। প্রত্যেকে ৪০০ টাকা করে দিয়েছি।
চতুর্থ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের পিকনিকের (বনভোজন) ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে সজল ঘোষ। কলেজে ৯০০ শিক্ষার্থী ১১০০ করে টাকা দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, সজল ঘোষ প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের তার কাছে থেকে বই ক্রয় করতে বাধ্য করতো।বাইরে থেকে বই ক্রয় করলেই নির্যাতন, পরীক্ষায় ফেল করে দেয়ার ভয় দেখাতেন।
মো. ফাহাদ হোসেন আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এবার চারটা বইয়ের জন্য সে আমাদের কাছে ১৬০০ টাকা করে নিয়েছে। গত বছর ওই বই আমাদের কাছে নিয়েছিল ১১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে ওই বইয়ের দাম সে সময় ছিল ৯০০ টাকা।
এই শিক্ষার্থী বলেন, সে সবাইকে বলতো যে, আমি এখানে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এসেছি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সে এখানে এসেছে বাণিজ্যের জন্য। আমরা তার কাছে ব্যবসার পণ্য।
প্রথম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজে পরীক্ষা হয় এক সেন্টারে। কিন্তু এখানে প্রিন্সিপালের সহায়তায় পরীক্ষা নেয় আলাদাভাবে। একজন পড়ালেখা করে পরীক্ষা দেয়। আর অনেকের কাছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ায়। আবার পরীক্ষায় পাস করার পর আমাদের কাছে মিষ্টি খাওয়ার জন্য ২০০ টাকা করে নেয়। প্রিন্সিপাল বলেন- আমি সজলকে চিনি না। সজল বহিরাগত। আমাদের কাছে প্রচুর ছবি, প্রমাণ আছে। প্রিন্সিপাল তাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। প্রিন্সিপালের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। উনি একটা চোর।
আইএইচটির শিক্ষার্থীরা জানান, সজল ঘোষ কলেজের গেটের দক্ষিণ পাশে তেঁতুল তলায় সব সময় বসে থাকতেন। শিক্ষার্থীদের এ পথ দিয়ে যেতে আসতে তাকে সালাম দিতে হতো। না দিলেই মারধর করতেন সজল। আর হোস্টেলের ২১৮ নম্বর রুমে সে বসবাস করতেন। নিজেই রুমটির মেঝে টাইলস করে নিয়েছেন। এ রুমেই সকল শিক্ষার্থী তার সেবাযত্ন করতেন। মদের আসর বসানো হতো সেখানে।
বিক্ষোভকারীরা জানান, সজল ঘোষের পাঠদানের কোনো জ্ঞান নেই। তারপরেও কলেজ কর্তৃপক্ষের সুনজরে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে মাইক্রোবায়োলজির ক্লাস নিতেন। ক্লাস প্রতি কলেজ তাকে ৫০০ টাকা করে সম্মানি দিত।
এসব অভিযোগের বিষয় জানার জন্য সজল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ থাকায় বক্তব্য তার পাওয়া যায়নি।
তবে সজল ঘোষের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বা অপকর্ম কখনো দেখেননি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজের ল্যাব ইনচার্জ আব্দুল কাদের বলেন, এখানে জাস্ট আসি ক্লাস নিই, চলে যাই। এখানে কি হবে না হবে তা দেখবে প্রশাসন। তবে তাকে কলেজে আসতে, বসে থাকতে আমরা দেখেছি। এর বাইরে কিছুই তিনি জানেন না, এগুলো প্রশাসনের দেখার বিষয়।
বহিরাগত হয়েও সজল ঘোষের হোস্টেলে থাকার বিষয়টি জানতেন না কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আমায়ত-উল-হাসিন। এসব দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যান কৌশলে। তার দাবি, সজল ঘোষকে চিনেন তিনি। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতেন। তবে সজল ঘোষ ছাত্র হোস্টেলে থাকতেন কিনা তা জানেন না অধ্যক্ষ।
আইএইচটির অধ্যক্ষ বলেন, সজল ছাত্রলীগ করে, এ হিসেবে চিনি। মজনু ভাই, আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে এসেছেন। পরিচয় করে দিয়েছেন। চা খেতে দেখেছি। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে সজলের জন্মদিনে তাকে মিষ্টি খাওয়ায়েছি।
বনভোজনের টাকা নেওয়ার বিষয়টি গতকাল জানতে পারেন বলে দাবি করেন অধ্যক্ষ। এটা তার ব্যর্থতা কিনা এমন প্রশ্নে আমায়ত-উল-হাসিন বলেন, এক হিসেবে তাই। কিন্তু ছাত্ররা আমাকে আগে বলেনি কেন? হোস্টেলে হাত-পা টেপার ভিডিও আমিও দেখিছি। কিন্তু এটা তো আমাকে জানায়নি। জানানো উচিত ছিল না? স্বনামে হোক, বেনামে হোক আমাকে জানাতে পারতো। এখন আমি তাকে যদি দেখতে পাই, জানতে পারি, প্রশাসনের হাতে তুলে দেব।
কলেজে বিক্ষোভের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সামির হোসেন মিশু ও জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম ।
ডা. সামির হোসেন মিশু বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সব অভিযোগ শুনেছি। আমরা এসব যাচাই করবো। আমাদের আইনগত যে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিবো।
জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ গেলে আমরা অবশ্যই আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিব।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির হোস্টেলের মিল ম্যানেজার ও শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলামকে মারধর করেন সজল ঘোষ। এই মারধরকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখার পর তারা কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। তখন থেকেই তারা কলেজের ভেতরে বিক্ষোভ চালিয়ে যান।
আরএআর