‘হামার সব শ্যাষ হইছে গতকাল থাকি’
‘আমার যেটুকু ভিটেমাটি আছিলো গতকালকে তিস্তার পেটোত চলি গেইছে। কোনো রকমে ঘরের চাল, বেড়া খুলি নিয়া নিছি। নিজের জায়গা জমিন বলতে আর নাই। সব শ্যাষ হইছে গতকাল থাকি।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাব খাঁ বড়দরগা এলাকার সামছুল ইসলাম (৫৫)।
তিনি বলেন, গতকাল থেকে বউ বাচ্চা নিয়ে মানুষের বাড়িতে আছি। মানুষ আর কতদিন থাকতে দিবে বলেন। আমি কৃষি কাজ করে খাই। জায়গা জমিন কিনে বাড়ি করার মত সামর্থ্য নাই। খুব চিন্তায় পড়ে গেছি, বেঁচে থাকবো কীভাবে। প্রায় ৮০ শতক বাপ-দাদার জমি ছিল ভাঙতে ভাঙতে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন কি হবে আল্লাহই ভালো জানেন।
কুড়িগ্রামের তিস্তা নদীতে পানি কমতে শুরু করায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা পাড়ের মানুষের। তবে তিস্তার পানি কমলেও এখনো পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিপৎসীমার অনেক নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদ-নদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও নীচু চরাঞ্চলগুলোতে বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের নতুন জেগে উঠা মুসার চর ও বালা ডোবার চরের ঘর-বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। অপরদিকে শত শত বিঘা জমির আমন ক্ষেত, সবজি ক্ষেত ও বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য চাষিরাও।
এদিকে নদ-নদীর পানি কমার ফলে রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের গতিয়াসাম, চর খিতাব খাঁ, বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুড়া, রামহরি ও কালিরহাট এলাকায় দেখা দিয়েছে তিস্তা নদীর ভাঙন। এছাড়া ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে এবং ধরলা নদীর অববাহিকার মোগলবাসা ইউনিয়নের চর সিতাইঝাড় এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের বড়দরগা গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও ভাঙে, পানি কমলেও ভাঙে। আমাদের সুপারির বাগানে প্রায় ২০০ টার মত গাছ ছিল। সেই বাগানের সুপারি বিক্রি করে সংসার চলতো। এখন মাত্র আর ২০-২৫টা সুপারির গাছ আছে। ভিটেমাটিসহ সব সুপারির গাছ নদীতে চলে গেছে। এখন সব শেষ, মাথা গোজারও ঠাঁই নেই কোথায় যাব। এ পর্যন্ত ৩ থেকে ৪ বার বাড়ি ভাঙছি।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাব খাঁ এলাকার স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) মামুন মিয়া জানান, তিস্তা নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। আমার এখানে গত ৫-৬ দিনে প্রায় ৫০টি মত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। এর মধ্যে অনেকের জায়গা জমি না থাকায় অন্যের বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়ে কোনোরকমে রাত কাটাচ্ছেন।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, আমার ইউনিয়নটি ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর ভাঙনে শেষ। গত ১ বছরে প্রায় ৭০০-৮০০ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বর্তমানে ৪০০-৫০০ পরিবার পানি বন্দী জীবন যাবন করছে। আমরা তাদের খোঁজ খবর রাখছি।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, বন্যার পানিতে ২ হাজার ৪০ হেক্টর জমির আমন ধান, ৯৮ হেক্টর জমির সবজি ও ১৬ হেক্টর জমির বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি শুকিয়ে গেলে এসব ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, রাত থেকে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। আমরা ভাঙন কবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের কাজ করছি।
মো. জুয়েল রানা/এএএ