জমিতে সেচ দেয় শিমুর ‘জাদুর বাক্স’, ৭০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয়
কৃষিতে ব্যবহৃত সেচ পাম্পের পাওয়ার ডিভাইস উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শিমশন সাহা শিমু নামে এক ব্যক্তি। তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছেন জাদুর বাক্স। সাধারণত ফোর হর্স সাইজের ছোট একটি শ্যালো মেশিন ও ৩ ইঞ্চি পাম্পে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লিটার পানি উত্তোলন করা যায়। সেখানে এই পাওয়ার ডিভাইসটি একই মেশিন ও পাম্পের সঙ্গে জুড়ে দিলে প্রতি সেকেন্ডে ১৮ লিটার পানি উত্তোলন করা সম্ভব। এতে সময়ের পাশাপাশি ৭০ শতাংশ জ্বালানি তেল সাশ্রয়ী হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এবং সরকারের আ্যসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) পরীক্ষায় যার প্রমাণ মিলেছে, মিলেছে সনদও। তবে অর্থাভাবে ও সরকার কিংবা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে থমকে আছে তার এই বিষ্ময়কর উদ্ভাবন। শিমুর এই ডিভাইসটি সরকারি অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে সারাদেশে যে জ্বালানি সংকট তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষিতে তার এই প্রযুক্তি ব্যবহার হলে অনেকাংশে কমে যাবে ফসল উৎপাদন খরচ। এতে কৃষক, সরকার উভয়ই লাভবান হবে।
জানা গেছে, শিমশন সাহা শিমুর বাড়ি উপজেলার রাধাগঞ্জ ইউনিয়নের নারিকেল বাড়ি গ্রামে। এলাকার একটি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখানে একটি কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু অর্থাভাবে আর বেশি দূর এগোতে পারেননি শিমু। কাজ শুরু চট্টগ্রামের একটি মেশিনারিজ কারখানায়। সেখান থেকে রপ্ত করেন বিভিন্ন মেশিন মেরামতের কাজ। ১৯৯৭ সালে নিজ গ্রামে এসে শুরু করেন নষ্ট শ্যালো মেশিন মেরামত ও ইরি ধানের ব্লকে সেচ দেওয়ার কাজ। কিন্তু প্রায় সময় জ্বালানি তেলের সংকটে বন্ধ হয়ে যেত ধানের জমিতে সেচ দেওয়া। এতে কৃষকের কাছ থেকে শুনতে হতো তাকে গালমন্দ।
সেই আক্ষেপ থেকে নিজের ব্যবহৃত বাইসাইকেল প্যাডেল করে উদ্ভাবন করে ফেলেন জ্বালানি ছাড়াই সেচযন্ত্র। কিন্তু সেটি অনেক কষ্টসাধ্য হওয়ায় আর আগ্রহ বাড়াননি শিমসন সাহা শিমু। পরে দীর্ঘ আট বছরের চেষ্টা ও পরিশ্রমে তৈরি করে ফেলেন এই মেকানিক্যাল পাওয়ার ডিভাইসটি। যা যেকোনো সেচ পাম্পের সাথে জুড়ে দিলে ৭০ পার্সেন্ট জ্বালানি সাশ্রয় হবে। ডিভাইসটি তৈরি করে সে বছরই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কৃষিতে অবদান রাখায় পুরস্কার পান তিনি। এরপর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে অর্থ চেয়ে আবেদন করেন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য।
তার আবেদনের প্রেক্ষিতে এটুআই ও বুয়েটে পরীক্ষায় পাঠানো হয় তার এই ডিভাইসটি। পরীক্ষায় ডিভাইসটির কার্যকারিতার প্রমাণ মিললে পান সনদও। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট বিভাগ এই মেকানিক্যাল পাওয়ার ডিভাইসটির অনুমোদন ও শিমসন সাহা শিমুকে উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুদান মঞ্জুর হলেও ২০১৪ -২০১৫ অর্থবছরে বাজেট শেষ হওয়ায় পরের বছরে তাকে অনুদান দেওয়া হবে বলে জানিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয় শিমুকে। এরপর আর তার খোঁজ নেয়নি কেউ।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন- শিমুর এই ডিভাইসটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে এলে উপকৃত হবে কৃষক। কমবে কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ।
>>> পাহাড়ের টিলায় মরুভূমির খেজুর চাষে স্বপ্ন বুনছেন নুরুল
এ বিষয়ে শিমসন সাহা শিমুর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, একটি ফোর হর্সের শ্যালো মেশিনের সাথে ৩ ইঞ্চির একটি পাম্পে মাটির দশ ফুট গভীর থেকে পানি তুলবে ০.২৫ কিউসেক। আর ওই মেশিন ও পাম্পের সঙ্গে এই ডিভাইসটি জুড়ে দিলে পানি তুলবে ১.০৬ কিউসেক। অর্থাৎ কয়েকগুণ বেশি। পাশাপাশি ১০০ লিটার পানি তুলতে যতটুকু জ্বালানি খরচ হবে। মেশিন ও পাম্পের সঙ্গে ডিভাইসটি জুড়ে দিলে একই পানি তুলতে ৭০ পার্সেন্ট জ্বালানি সাশ্রয় হবে। যা কৃষকের জন্য হবে আশীর্বাদ স্বরূপ।
তিনি বলেন, আমি এই ডিভাইসটি সরকারি অর্থায়নে উৎপাদনে আনার জন্য বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে ঘুরেছি। কিন্তু তারা বার বার আশ্বাস দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডিভাইসটি ৭০ পার্সেন্ট জ্বালানি সাশ্রয়ী বলে বুয়েট ও এটুআইয়ের পরীক্ষায় এসেছে। তারা আমাকে সনদও প্রদান করেছে। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন বিভাগ থেকে এই মেকানিক্যাল পাওয়ার ডিভাইসটির অনুমোদন ও আমাকে একজন উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে অর্থাভাবে আমার এই আবিষ্কার থমকে আছে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদনের জন্য কোনো অর্থ পাই তাহলে আমি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসতে পারি। এই ডিভাইসের মাধ্যমে কৃষক উপকৃত হবে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদন খরচ অনেকটা কমে আসবে।
একই এলাকার রহিম মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, এই বাক্সটা মাঝেমধ্যে শিমু দাদার কাছ থেকে নিয়ে আমরা সেচ পাম্পে ব্যবহার করি। তাতে আমাদের অনেক জ্বালানি তেল সাশ্রয়ী হয়। এটি সরকারি অর্থায়নে উৎপাদন করলে এবং সেটি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিলে কৃষকরা অনেকটা উপকৃত হবে। ফসল উৎপাদন খরচ ও সময় দুইটি বাঁচবে।
গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. কাদের সরদার বলেন, এই ডিভাইসটি সেচ পাম্পে ব্যবহৃত হলে ফসল উৎপাদন খরচের পাশাপাশি কৃষকের সময় বেঁচে যাবে। যেখানে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে এই ডিভাইসটি ব্যবহারের ফলে সময় লাগবে ২৫ মিনিট। পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয় হবে ৭০ পার্সেন্ট। এতে কৃষক ও সরকার উভয়ে লাভবান হবে।
আশিক জামান/আরকে /আরএআর