গাইবান্ধায় ছড়িয়ে পড়েছে লাখ-কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার গুজব
‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন থেকে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে গাইবান্ধা জেলাজুড়ে। কেউ জানেন এককালীন, আবার কেউ জানেন ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে। তবে কারা এই টাকা দেবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত নন কেউই।
এমন ঋণের গুজবে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে যাচ্ছে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পদুমশহর ইউনিয়নের পদুমশহর গ্রামের মিয়া বাড়িতে। সেখানে আরিফ (৩৫) নামে এক যুবক পূরণ করে নিচ্ছেন ঋণের এসব ফরম। গত ১৫ দিন থেকে চলছে এ কার্যক্রম।
স্থানীয়রা বিষয়টি প্রতারণা বুঝতে পেরে পুলিশকে অবগত করলেও থামেনি ফরম বিতরণ। তাদের অভিযোগ, পুলিশকে জানানো হলে তারা এসে ফরম বিতরণকারী আরিফের সঙ্গে কথা বলে যায়। কিন্তু বন্ধ হয়নি ফরম বিতরণ।
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) বিকেলে সরেজমিনে সাঘাটা উপজেলার পদুমশহর ইউনিয়নের পদমশহর গ্রামের মিয়া বাড়ি গেট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মিয়া বাড়ি রেলগেটের আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৫টি ইজিবাইক, অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। যার প্রত্যেকটির পাশেই বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। তবে বেশির ভাগই ছিল নারী। সেখানকার রেলগেট সংলগ্ন আরিফের মুদি দোকানে বসে ফরম পূরণ করছেন আরিফ। দোকানের সামনে এবং আশপাশে হাজার হাজার নারী অপেক্ষায় রয়েছেন ফরম পূরণের। আবার কাউকে কাউকে দিচ্ছেন ফরম। ফরম দিয়ে বলা হচ্ছে নিজ দায়িত্বে পূরণ করে রাতে অথবা আগামীকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ফরম পূরণ করতে নেওয়া হচ্ছে জাতীয় পরিচয় পত্রের (এনআইডি) নম্বর এবং মোবাইল নম্বর।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকার কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের নাম করে প্রতিজনকে এক লাখ থেকে কোটি টাকা করে ঋণ দেওয়ার কথা জানান ওই এলাকার আজল হকের ছেলে আরিফ (৩৫)। এরপর থেকেই গত ১৫ দিন যাবত জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ মিয়া বাড়ির গেট বাজারে আরিফের দোকানে আসতে থাকে। আরিফ দোকানে বসে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষদের কাছ থেকে এনআইডি কার্ডের নম্বর বা ফটোকপি এবং মোবাইল নম্বর নিয়ে একটি ফরম পূরণ করে তার কাছেই রেখে দেন। জানান, আপনার সঙ্গে পরবর্তীতে ঢাকা থেকে যোগাযোগ করবে।
এ সময় জানতে চাইলে জেলার সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের শাপলামিল এলাকা থেকে যাওয়া আঁখি বেগম বলেন, আমি এক সপ্তাহ আগে লোক মারফত জেনেছি যে, এক লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। এজন্য মোবাইল নম্বর ও এনআইডি নম্বর লাগবে। এজন্য আরিফ ভাইয়ের কাছে এসে ফরম পূরণ করে দিলাম। আমার গ্রামের অনেক মহিলাই এসে ফরম পূরণ করে গেছেন।
কবে এবং কারা দেবে এই টাকা? এমন প্রশ্নের জবাবে ‘কিছুই জানি না’ বলে উত্তর দেন এই নারী।
একই উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের অটোরিকশা চালক সাদ্দাম মিয়া বলেন, এক লাখ করে টাকা দেবে। এজন্য আমার গ্রাম থেকে গত কয়েক দিন যাবত প্রতিদিনেই আটোভর্তি যাত্রী নিয়ে আসছি। আজও ছয়জনকে নিয়ে আসছি। তারা এনআইডি কার্ডের নম্বর আর মোবাইল নম্বর দিয়ে ফরম পূরণ করে দিয়ে যাচ্ছে।
পদুমশহর এলাকার স্থানীয় আব্দুস সালাম বলেন, গত ১৫ দিন থেকে লাখ টাকা দেওয়ার নামে ফরম বিতরণ করছেন আরিফ। আসলে কে দেবে এত টাকা? আর কারাইবা এর সঙ্গে জড়িত আমরা কিছুই জানি না। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী আসছে, ফরম পূরণ করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিষয়টি প্রতারণা মনে হয়েছে। আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। পুলিশ এসেও ছিল। কিন্তু ফরম বিতরণ বন্ধ হয়নি।
সাঘাটা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিব হোসেন জানান, স্থানীয়দের খবরে পুলিশ পাঠিয়ে ফরম বিতরণ বন্ধ করা হয়েছিল। ওই যুবককে ফরম বিতরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে, কৌশলে ছিটকে পড়েন ফরম বিতরণকারী আরিফ। পরে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে ফরম বিতরণকারী আরিফের ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, টাকা দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। কয়েকদিন পর এসব নম্বরে ফোন দিয়ে বিভিন্ন বাহানায় ১০০ করেও যদি টাকা নেয়, তাদের কোটি টাকা আয় হবে। এসব ভুয়া। ব্যক্তিগতভাবে অনেক জনকেই এই ফরম পূরণে নিষেধ করেছেন বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব বলেন, এনআইডি নম্বর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেখানে সেখানে, যাকে তাকে এই নম্বর হস্তান্তর করা উচিত নয়। কেননা, এই নম্বর দিয়ে অনৈতিক ঘটনা ঘটতে পারে। এতে ব্যক্তির অপূরণীয় ক্ষতিও হতে পারে। এজন্য স্থানীয় প্রশানের বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেওয়ারও পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
রিপন আকন্দ/আরএআর