৪২ এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৪ ছাত্রীই বাল্যবিয়ের শিকার
করোনার প্রকোপ কমলেও থেমে নেই বাল্যবিয়ের প্রকোপ। বাল্যবিয়ের প্রকোপে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বোয়ালমারী দ্বি-মুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ৪২ জন ছাত্রী রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষা দিয়েছিল মাত্র ৮ জন। এই ৮ জনের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৪ জন। বাকি ৩৪ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে অংশই নেয়নি পরীক্ষায়। পরীক্ষার এমন ফলাফল বিপর্যয় ঘটায় আলোচনায় উঠে এসেছে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিনে স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-বাংলাবান্ধা মহসড়কে বোয়ালমারী বাজারের পাশেই বোয়ালমারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি অবস্থিত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রামীণ পরিবেশে দৃষ্টি নন্দন বিদ্যালয়ের ক্যম্পাস গড়ে উঠেছে। রয়েছে খেলাধুলার মাঠ। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৪ সালে। ২০০২ সালে এমপিওভুক্ত হয়। ২০২২ সালে একটি নতুন ভবনও স্থাপন করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১০ জন শিক্ষক নিয়মিত পাঠদানের সঙ্গে সংযুক্ত আছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ভালো থাকলেও এ বছর শিক্ষার মান ও হার বিপর্যয় ঘটেছে। এর কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এলাকাটিতে আর্থিক অসচ্ছলতা, অভিভাবকমহলের অসচেতনতা ও এক শ্রেণির দালাল চক্র তৈরি হওয়ায় ব্যাপক হারে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ম শ্রেণির ১০ শিক্ষার্থীর গোপনে বাল্যবিয়ে হয়ে যায়। এছাড়া অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের গোপনে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তারা আরও বলছেন, প্রতিনিয়ত বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে এ এলাকায়। বিদ্যালয়ের পাশের উত্তর বোয়ালমারি, দক্ষিণ বোয়ালমারী, ছোপাগজসহ এই এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামে প্রতিনিয়ত নারী শিক্ষার্থীদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাতের আধারে এলাকায় কিংবা অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অমতে বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।
বোয়ালমারী গ্রামের হাজেরা বেগম নামের এক অভিভাবক জানান, আমরা গরিব লোক। ভালো ছেলে পেয়েছি তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারি না।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কমিটির সদস্য এবং অভিভাবকরা বলছেন, আগে বিদ্যালয়টির শিক্ষাব্যবস্থা ভালো ছিল। চলতি সালে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে। ৪২ জন ছাত্রী পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন ফরম ফিলাপ করলেও বাল্যবিয়ের কারণে পরীক্ষায় দিতে পারেনি ৩৪ জন ছাত্রী। মাত্র ৮ জন পরীক্ষা দিলেও পাস করেছে ৪ জন ছাত্রী।
পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলের মধ্যে রয়েছে পরস্পর অভিযোগ। অভিভাবকরা শিক্ষকদের দায়ী করে বলেন, শিক্ষকদের দায়িত্বের অবহেলার কারণেই এমনটি ঘটছে। ফাতেমা বেগম নামের এক অভিভাবক জানান, শিক্ষকদের স্কুলের প্রতি গুরুত্ব কম। তারা ঠিকমত শিক্ষার্থীদের সেভাবে পড়িয়ে ভালো ফলাফলের জন্য তৈরি করতে পারেনি। প্রধান শিক্ষক গুরুত্ব দিলে অন্য শিক্ষকরা গুরুত্ব দেয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল ইসলাম বলেন, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে সত্য। এটায় শুধু শিক্ষকদের সমস্যা নয়, অভিভাবকদেরও সমস্যা। নিজেদের অর্থায়নের শিক্ষার্থীর ফরম ফিলাপ করিয়েও তারা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ভাড়াও দেই। তারপরও অভিভাবকরা মেয়েদের অল্প বয়সে গোপনে বিয়ে দেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে দেয় না। অভিভাবকরা সচেতন নয়।
বিদ্যালয়টির ব্যবস্থা কমিটির সভাপতি আকবর আলী জানান, করোনাকালীন সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই এলাকার মানুষ সচেতন নয়। আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকে বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি।
সংশ্লিষ্ট শালবাহান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, বোয়ালমারী এলাকায় একটি সিন্ডিকেট বাল্য বিবাহের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তারা রাতের আধারে অন্য ইউনিয়নে নিয়ে গিয়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। এর বিনিময়ে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করছেন। তিনি প্রশাসনের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহাগ চন্দ্র সাহা জানান, বিষয়টি নিয়ে তারা সচেষ্ট রয়েছেন। তেঁতুলিয়া কয়েকটি স্কুল ভালো করলেও বোয়ালমারী স্কুলের ঘটনাটি দুঃখজনক। আর যেন কোনো শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার না হয় এই ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
এসকে দোয়েল/আরকে