আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর আছে, মানুষ নেই!
ফেনীর ছাগলনাইয়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্বজনপ্রীতির কারণে ভূমিহীনমুক্ত হতে পারেনি অসহায় হতদরিদ্ররা। ইতোমধ্যে এ উপজেলাকে প্রাথমিকভাবে ভূমিহীনমুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও বাস্তবচিত্র চিত্র উল্টো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এ অঞ্চলের অনেক অসহায় মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছে না। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে এমন অনেক প্রকৃত ভূমিহীন মানুষের সন্ধান মিলেছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৫ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ১৫১টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। তার মধ্যে ছাগলনাইয়া পৌর এলাকায় ২৩টি, উত্তর সতর নদীর কূলে ১১টি, মাটিয়াগোদা গ্রামে ১০টি, সত্যনগরে ১০টিসহ মহামায়া ইউনিয়নে মোট ৩১টি, পাঠাননগর ইউনিয়নে ৩৮টি, রাধানগর ইউনিয়নে ২৪টি, শুভপুর ইউনিয়নে ১৫টি এবং ঘোপাল ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তবে সরেজমিনে আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, বরাদ্দকৃত ঘরের মধ্যে ৪৯টি ঘরে তালা ঝুলছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ৪৯টি ঘর যাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাদের কেউ আশ্রয়ণে থাকে না। তাদের মধ্যে সবার স্বচ্ছল, বাড়িঘর ও আবাদি জমি রয়েছে। আবার অনেকে নিজের নামে ঘর বরাদ্দ নিয়ে মাসিক ভাড়ায় কিংবা নিজের স্বজনকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। উপজেলার সব ইউনিয়নের আশ্রয়ণে স্থানীয় এক বা একাধিক গ্রাম পুলিশের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এদের অধিকাংশই আশ্রয়ণের ঘরে থাকে না।
স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, ছাগলনাইয়া পৌর এলাকায় ২৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেখানে বরাদ্দের পর মোশারফ হোসেন, স্বপন, মো. সরোয়ার ও মো. রিয়াজের ৬টি ঘরে কেউ থাকে না। এছাড়া আমেনা বেগম নামে এক নারীর গ্রামের বাড়িতে নিজস্ব জায়গায় জমিসহ ঘরবাড়ি থাকার পরও একজন সরকারি কর্মকর্তার সুপারিশে তাকে একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
একইভাবে উপজেলার মহামায়া ইউনিয়নের ৩১টি ঘরের ১৫টিই ফাঁকা পড়ে আছে। ইউনিয়নের দক্ষিণ সতর নদীকূলে অবস্থিত আশ্রয়ণে ১১ টি ঘর রয়েছে। এখানে উপকারভোগী মো. রাশেদ, রাহেনা আক্তার, মো. আলম, আলমগীর, মোজাম্মেল এবং সাবেদ আলীসহ ৭টি পরিবার আশ্রয়ণের ঘরে থাকে না। এখানের ৪ নম্বর ঘরটি মো. আলমের নামে বরাদ্দ হলেও সে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে শাহেনা আক্তার নামে এক নারীর কাছে বিক্রি করেছে বলে জানা যায়।
মাটিয়াগোদা গ্রামে রয়েছে ১০টি ঘর। এখানে শরিফা খাতুন, নাছির উদ্দিন, শরিফ হোসেন এবং ওমর ফারুকের নামে বরাদ্দকৃত ঘরে দীর্ঘদিন তালা ঝুলছে। আশ্রয়ণের বাসিন্দারা জানান, এদের কেউ এখানে থাকে না। ইউনিয়নের সত্যনগরে অবস্থিত আশ্রয়ণে রয়েছে ১০টি ঘর। এখানে শাফিয়া আক্তার, আমির হোসেন, দ্বীন ইসলাম ও তাজ নেহারের নামে বরাদ্দকৃত ঘরেও কেউ থাকে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
উপজেলার পাঠাননগরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভূমি ও গৃহহীনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৮টি উপহারের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাদের অনেকে শুধু সরকারি কর্মকর্তা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পরিদর্শনে আসার খবর পেয়ে ছুটে এসে অবস্থান জানান দেন। আবার অনেকে পাশের কোন বাসিন্দার কাছে নিজ ঘরের চাবি জমা রাখে। সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি কিংবা গণমাধ্যমকর্মী আসলে ওইসব ঘরের তালা খোলা হয়। এখানে বরাদ্দ পাওয়া তাসলিমা আক্তার, শহিদ, নাজমা আক্তার, আছমা আক্তার চৌধুরানী এবং নুর নবীসহ ৬ জনের ঘরেও কেউ থাকে না।
উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২৪টি ঘর রয়েছে। স্থানীয় আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে জানান, এখানে নাছির উদ্দিন, ওবায়দুল হক, মো. হারুন, ইমাম হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী, নুরুল আলম নামে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার নামে বরাদ্দকৃত ঘরে কেউ থাকে না। এ ব্যাপারে জানতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নুরুল আলমের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
একইভাবে শুভপুর ইউনিয়নের জয় চাঁদপুর এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৫টি ঘরে ঝুলছে তালা। আশ্রয়ণের এক বাসিন্দা জানান, এখানে বরাদ্দকৃত ঘরগুলোতে প্রায় ১০ জনের বেশি উপকারভোগী একদিনের জন্যও ঘরে আসেনি। কেউ বসবাস না করায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আঙ্গিনা ঝোপঝাড়ে ভরপুর হয়ে পড়েছে।
জমির আলী নামে এক বাসিন্দা বলেন, এখানে আলতাফ হোসেন, আয়েশা বেগম, জাফর আহাম্মদ, তাছলিমা আক্তার, জেবুন্নেসা, জরিফা খাতুন, মো. জসিম উদ্দিন, ফিরোজা বেগম, হাছিনা বেগম এবং গ্রাম পুলিশ তুষার চন্দ্র দাসের নামে বরাদ্দকৃত ঘরগুলোতে কেউ থাকে না।
গ্রাম পুলিশ সদস্য তুষার চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে যেখানে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জায়গাটি পছন্দ হয়নি, তাই ঘরে উঠিনি। এছাড়া তাছলিমা আক্তার আশ্রয়ণে ঘর বরাদ্দ পেয়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছেন। ওই ঘরে বর্তমানে তার স্বজনরা থাকছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য ইউনিয়নের মত একইভাবে ছাগলনাইয়া ঘোপাল ইউনিয়নের ৫টি ঘর ও দুর্গাপুর সিংহনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৫টি ঘরে ঝুলছে তালা।
এসব অনিয়মের বিষয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌমিতা দাশ ঢাকা পোস্টকে জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। আশ্রয়ণে ঘর বরাদ্দ পেয়েও যারা থাকছে না তাদের নাম বাদ দিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এ ব্যাপারে ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পেয়েও যারা সেই ঘরে তালা লাগিয়ে রেখেছে, নিশ্চয়ই তাদের ঘর প্রয়োজন ছিলো না। প্রকৃত ভূমিহীনদের এসব ঘর বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
তারেক চৌধুরী/আরকে