২ সন্তানকে ঘরে তালাবদ্ধ করে জীবিকার সন্ধানে নিরুপায় বাবা
স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে। তেল চিটচিটে বিছানায় খেলা করছিল দুই ভাই-বোন। মরিয়মের বয়স সাড়ে তিন বছর। ভাই নূরের বয়স ১৮ মাস। সিলিংয়ে ঘড় ঘড় শব্দে ঘুরছে ফ্যান, তাতেও কাটছে না ভ্যাপসা গরম। এভাবে তালাবদ্ধ ঘরেই জীবন কাটছে ভাই-বোনের। প্রস্রাব-পায়খানা করে নোংরার মাঝেই বসে থাকতে হয় তাদের। পিপাসা লাগলে জানালা দিয়ে বাইরে কাউকে ডেকে বলে, পানি খাব।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ড পশ্চিম কাউনিয়া হাজেরা খাতুন স্কুল সড়কের মোহাম্মদিয়া মসজিদ সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসার এককক্ষে এমন মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে দুই শিশু। দুজনের মুখেই স্পষ্ট কথা ফোটেনি। মারজান আধো আধো নিজের কথা বলতে পারলেও কথা ফোটেনি ছোট্ট নূরের মুখে।
দুই ভাই-বোনের বাবা রনি সিকদার ফিরোজ। পেশায় একজন রিকশাচালক। তিনিই মারজান ও নূরের একাধারে মা-বাবা। কারণ শিশু দুটির মা বেঁচে নেই। হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যু।
পেট চালানোর দায়ে শিশু দুটিকে ঘরে তালাবদ্ধ করে বের হয়ে যেতে হয় বাবা ফিরোজের। কারণ তাদের দেখার আর কেউ নেই। তবে সারাদিন পর তালা খুলে বাবা ঘরে ঢুকলেই হাসির ঝলক বয়ে যায় মারজান-নূরের মুখে। এভাবেই ফিরোজ দুই সন্তানকে নিয়ে পিতৃত্বের চরম পরীক্ষা দিয়ে চলেছে প্রতিটি মুহূর্তে।
ফিরোজ বলেন, ওদের তালাবদ্ধ ঘরে রেখে যেতে খুব খারাপ লাগে। খুব টেনশন হয়। আমার সন্তানদের জন্য আবার যদি জেলে যেতে হয়? এমন আতঙ্ক আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। টেনশনে গাড়িও ঠিকমতো চালাতে পারি না। আবার ওদের নিয়ে যখন বাইরে বের হই তখন অনেক যাত্রী উঠতে চায় না। ওরাতো নিজেরাই বসতে পারে না। সেখানে রিকশা ধরে বসে থাকা খুব কষ্টের। যদি পিছন থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়, তাহলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে। তাই বাড়িতে তালা দিয়ে রেখে যাই।
ফিরোজ বলেন, আমিতো নিরুপায় বাবা। বিনা দোষে জেল খেটেছি। আমি বুঝি জীবনে কষ্ট কাকে বলে। ওরা আমার সন্তান। আমিতো ফেলে দিতে পারব না। আমার মা ছোট বেলায় মারা গেছেন। আমি বুঝি কষ্ট আসলে কি? সন্তানদের কষ্ট হলেও নিজেই লালন-পালন করি। বিয়ে করিনি যদি নতুন বউ এসে আমার সন্তানদের তাড়িয়ে দেয়। আজকালকার যুগতো ফেসবুক-ইউটিউবের যুগ। আবার প্রতিবেশীরা হয়তো বুদ্ধি দেবে, কেন সে দুটি সন্তানের বাবার সঙ্গে বিয়ে বসেছে। এই ভয় আর বিয়ে করি না। আমি আমার স্ত্রী হারিয়েছি, সন্তানদের হারাতে চাই না। আমিতো আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম। দুজনের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু কি যে হলো ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর! আমার স্ত্রী মারজান আত্মহত্যা করলো।
ফিরোজ ঝালকাঠির কিস্তাকাঠি গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে। প্রায় ১৫ বছর আগে বরিশালে এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। ২০১৯ সালে তার বিয়ে হয় আগৈলঝাড়ার বাসিন্দা মারজানের সঙ্গে। রিকশা চালিয়েই সংসার চলতো তাদের। দুজনের মধ্যে সাংসারিক কলহও হতো। ২০২১ সালে মারজান ও রনির দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে মরিয়মের বয়স ছিল ১৮ মাস আর ছোট ছেলে নূরের বয়স ছিল ৫ মাস।
ফিরোজ বলেন, ওই বছরের ডিসেম্বরের মাঝমাঝি সময়ে আমার স্ত্রী তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। আমি নিজে রিকশায় তাদের নামিয়ে দিয়ে আসি। মাঝেমধ্যে মোবাইলে কথা হতো। আমার শাশুড়ি প্রায়ই বলতেন রিকশাওয়ালার কাছ থেকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে বিয়ে দেওয়াবেন। ৩০ ডিসেম্বর ভোর রাতে আমার শাশুড়ি কল দিয়ে আগৈলঝাড়া যেতে বলেন। আমি গিয়ে দেখি আমার স্ত্রীর লাশ ঝুলছে। কোনো কিছু বোঝার আগেই তারা আমাকে ধরে গরু দড়ি দিয়ে বেঁধে মারধর করে পুলিশে দেয়। আমার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে আমি চারমাস ১৮ দিন কারাগারে ছিলাম। তবে আত্মহত্যার প্ররোচণার প্রমাণ না পাওয়ায় আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।
এরপর ফিরোজ সন্তানদের নিজের কাছে নিয়ে এসে ওঠেন পশ্চিম কাউনিয়ার সেই পুরানো ভাড়া বাসায়। এক রুমের বাসায় মাসে ১৭শ টাকা ভাড়া দেন। আর দিনে ভাড়া রিকশায় দেন ৩০০ টাকা। বাকি যা আয় করেন তাতেই চলে দুই সন্তান আর তার জীবন। সন্তানদের ভালো কোনো জামা-কাপড় নেই পরিধানের জন্য। নেই তৈজসপত্রও।
স্ত্রী আত্মহত্যা করার কারণও আজ পর্যন্ত তিনি জানেন না। এমনকি স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তার বাবার বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির কেউ কোনো যোগাযোগ রাখেনি। তাই বলে তিনি জীবনের কাছে হেরে যেতে চান না।
আসহায় এই বাবা আরও বলেন, জীবনে যতদিন বেঁচে আছি আমার সন্তানদের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এখন প্রতিদিন ভোরে উঠে ওদের গোসল করাই। নাশতা করিয়ে তালা মেরে রিকশা নিয়ে বের হই। দুপুর ১টার দিকে ঘরে ফিরে দুপুরের রান্না করি। খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিয়ে বিকেল সন্তানদের রিকশার সিটে বসিয়ে বের হই। তখন হয়তো দুচারজন যাত্রী পেলেও পেতে পারি। বিশেষ করে সিটে বাচ্চা বসা দেখলে উঠতে চায় না কেউ। এভাবে দিন চলছে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি কেউ আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন বা কেউ একটা দোকানের ব্যবস্থা করতেন তাহলে সন্তানদের দেখাশুনাও করতে পারতাম আর জীবনও চলতো।
প্রতিবেশী রুনু বেগম বলেন, ফিরোজ যখন বের হন তখন অনেকের কাছে ঘরের চাবি দিয়ে যেতে চান। কিন্তু আমরা ভয়ে রাখি না যদি কিছু হয়। তবে অবুঝ দুই শিশুকে এভাবে ঘরে তালা মেরে যান দেখেও খুবই খারাপ লাগে। তবে মরিয়ম আর নূর জানালা থেকে প্রায়ই বলেন ক্ষুধা লাগছে নয়তো পানি খাবে। আমি এসে খাওয়ায়ে দিয়ে যাই। ওদের সঙ্গে জানালা থেকে কথাবার্তা বলি।
আরেকজন সুলতান হাওলাদার বলেন, রনি প্রতিদিন আমার দোকানে তার ঘরের চাবি রেখে যান। প্রায়ই আমি এসে মরিয়ম ও নূরের খোঁজ নিয়ে যাই। দেখাশুনা করি। সত্যি কথা ওদের এই অবস্থা দেখে খুবই কষ্ট হয়। মেনে নিতে পারি না। কিন্তু আমাদেরতো করার কিছু নেই। যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে রনিকে একটা দোকান করে দিতাম। তাহলে ওর সন্তানদের এভাবে ফেলে কাজে বের হতে হতো না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখব এবং শিশু সুরক্ষা আইন অনুসারে যা করার দরকার তার সব ব্যবস্থা করব।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে