গরুর পায়া খেতে আল আমিনের দোকানে অপেক্ষা করতে হয় ক্রেতাদের
ভোজনরসিকদের কাছে গরুর পায়া অনেক আগে থেকেই সমাদৃত। ঠিক কবে এই খাবারের প্রচলন হয় তা নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও যতদূর জানা যায়, অষ্টাদশ শতকে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্দর মহলের খাবার ছিল পায়া। দরবারে প্রতিদিন সুস্বাদু পায়া পরিবেশিত হতো সকালের খাবার হিসেবে।
সময়ের পরিক্রমায় মোঘল সাম্রাজ্য আর নেই। তবে দরবারের অন্দর পেরিয়ে লোভনীয় পায়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বমহলে। শুধু ঘরেই না যুগ যুগ ধরে বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।
এই পায়া খেতে যদি দুই ঘণ্টা অপেক্ষা আর লাইনে দাঁড়াতে হয় তাহলে কি অবাক হবেন? এমন ঘটনাই ঘটছে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মানিককাঠি বাজারে। হযরত শাহ জালাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নাম হলেও পুরো বিভাগে নাম ছড়িয়েছে আল আমিনের পায়ার দোকান নামে।
আনুমানিক ৩০ বছর ধরে দোকানটির খবর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। আল আমিন হাওলাদারের বাবা ওমর আলী হাওলাদার শুরু করেন এই ব্যবসা। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঢাকার চাকরি ছেড়ে দোকানের হাল ধরেন আল আমিন। দেখতে দেখতে ১৫ বছর দোকান চলছে আল আমিনের হাতেই। তবু পায়ার স্বাদ অটুট রয়েছে আজও।
দোকানে সাজ্জাদ ও রাকিব নামের দুজন সহযোগী কর্মচারী রয়েছেন। গরুর পা সংগ্রহ থেকে প্রক্রিয়াজাত করে রান্না, এরপর ভোজনরসিকদের প্লেটে তুলে দেওয়া অবধি নিজে হাতেই সব করেন আল আমিন। এমনকি মানহীন হবে এমন পায়া সংগ্রহ করেন না। আবার খাবার শেষে মতামত জেনে নেন আর কি হলে ভালো হতো?
আল আমিন বলেন, যারা খেতে আসেন তারাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন এক পিস পায়া নিতে। এমনও হয়েছে পায়া নিতে এসে ক্রেতার সঙ্গে ক্রেতার ঝগড়া লেগে গেছে। তবে কখনোই আমি মানহীন কিছু তৈরি করি না। মানহীন খাবার তৈরি করলে হয়তো দিনে ৫০০ পিস পায়া বিক্রি করতে পারতাম। তাহলে মানুষ ভালোবেসে আমার দোকানের জন্য বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে অপেক্ষায় থাকতেন না।
তিনি বলেন, বরিশালের বিভিন্ন বাজার খুঁজে দিনে মানসম্পন্ন ৮০/১০০টি গরুর পা এনে প্রস্তুত করি। যে গরুর পায়ে মাংস নেই বা অতিরিক্ত চর্বিওয়ালা সেগুলো আমি নিই না। আমার দোকানের পায়া বাছাই করা। খারাপ লাগে যখন দিনে কম করে হলেও ৫০ জন ক্রেতা ফিরে যান খালি হাতে। মানসম্পন্ন পায়া পেলে তাদের খালি হাতে ফিরতে হতো না।
আল আমিন বলেন, ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে প্রতি পিস পায়া বিক্রি করি। পাশাপাশি রুটিও বিক্রি করি। এতে দিনে ১০-১৫ হাজার টাকার পায়া বিক্রি হয়। সকালে গরুর পা সংগ্রহ করতে বের হয়ে দুপুরে বাসায় ফিরে পরিবারের সকলের সহায়তায় সেগুলো উপযোগী করে বিকেলে দোকানে এসে রান্না শুরু করি। রান্না করতে করতে সন্ধ্যা ৬টা বেজে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সবগুলো বিক্রি হয়ে যায়। দিনে কয়েকশ পায়ার অর্ডার পাই। কিন্তু সেই অর্ডার নিতে পারি না। নিব কেমনে, ভালো গরুর পা না পেলে মানুষ ঠকিয়েতো লাভ নেই। এই ৩০ বছর ধরে মানুষ ভালোবেসে আমার দোকানে এসে খেয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সুতরাং তাদের ঠকানো আমার দ্বারা অসম্ভব।
পায়া খেতে আসা তরিকুল ইসলাম বলেন, পটুয়াখালী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে মানিককাঠি এসেছি পায়া খেতে। আমার মতো এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা পায়া খেতে আল আমিনের দোকানে ছুটে আসেন। কাজের তাগিদে বিভিন্ন স্থানে গেলে শখের বসে পায়া খেয়েছি। তবে আমার কাছে আল আমিনের দোকানের পায়া ভিন্ন ও সুস্বাদু লাগে।
আগৈলঝাড়ার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, মাঝেমধ্যে এই দোকানে আসি বিকেলের নাস্তা খেতে। আগে মোবাইলে অর্ডার দিয়ে রাখলে রেখে দিতো। কিন্তু এখন আর আগে অর্ডার না দিলে পাওয়া যায় না।
আরাফাত নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ১০ পিস পায়া নিতে এসেছিলাম। কিন্তু ৬ পিস পেয়েছি। আল আমিন ভাই জানিয়েছেন আরেক জেলা থেকে এসে কয়েকজন অপেক্ষায় আছেন। ১০ পিস আমাকে দিলে তারা মোটেও পাবেন না। এজন্য আমাকে কম নিতে হলো।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ