৪ বছরেও শুরু হয়নি দৌলতদিয়ায় ঘাট আধুনিকায়নের কাজ
বর্ষা মৌসুম শুরু না হতেই রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় শুরু হয়েছে নদীভাঙন। হঠাৎ নদী ভাঙনে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পদ্মাপাড়ের হাজারো মানুষ। অথচ চার বছর আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট আধুনিকায়নের জন্য ১ হাজার ৩৫০ কোটি ৭০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। এরপর দীর্ঘ চার বছর পেরিয়ে গেলেও শুরু হয়নি ঘাট আধুনিকায়নের কাজ। এতে প্রতি বছরই ভাঙনের কবলে পড়ে দৌলতদিয়া এলাকা। ভিটেমাটি হারাচ্ছে শত শত পরিবার।
জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের প্রবেশদ্বার নামে পরিচিত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট। এই ঘাট ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ও যানবাহন তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়। যাত্রী ও যানবাহন পারাপার নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে এবং ভাঙনরোধে বিআইডব্লিউটিএ এই ঘাট দুটিকে আধুনিক নৌ-বন্দর করার পরিকল্পনা করে এবং সে অনুযায়ী একটা বাজেটও পাস হয়।
আধুনিকায়নের কাজ পায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু কাজ শুরু হতে বিলম্ব হওয়ায় এবং দ্রব্য মূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয় দ্বিগুণ। যার ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের করা প্রকল্পের নকশার পুনরায় বিশ্লেষণ করতে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)।
এদিকে প্রতি বছরের মতো এবারও বর্ষা মৌসুম আসার আগেই শুরু হয়েছে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙন। ধীরে ধীরে পদ্মা ও যমুনার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতা। সর্বশেষ পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়েছে দৌলতদিয়ার ১৮টি গ্রাম। এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে প্রায় ৮০০ হেক্টর জমি। নতুন করে আবার দৌলতদিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ঝুঁকিতে রয়েছে ২৫০টির মতো বসতভিটা, দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট, ফেরিঘাটসহ নানা স্থাপনা।
অথচ নৌবন্দর আধুনিকায়নের মতো বড় কাজ শুরু হওয়ার আগে নদী শাসন ও অন্যান্য বছরের মতো আপদকালীন কোনো কাজও হচ্ছে না ভাঙনরোধে। এদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌবন্দরের আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ ফাইল ও বুয়েটের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আটকে আছে। কাজের অপেক্ষায় ভাঙন প্রতিরোধে কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপাড়ের অসংখ্য মানুষ।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও এর পশ্চিমে দেবগ্রাম প্রান্তে ছয় কিলোমিটার এবং পাটুরিয়া ঘাটে দুই কিলোমিটার স্থায়ীভাবে আধুনিকায়ন করতে বিআইডব্লিউটিএ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৬৮০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন করে। পরে এই নৌ-পথের স্থায়ী আধুনিকায়নের কাজ ২০২১ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে হস্তান্তর করে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু করতে না পারা এবং নির্মাণ-সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এ কাজের বর্তমান ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ৭০ লাখ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প পাশের প্রায় চার বছর পার হলেও এখনো শুরু হয়নি ঘাট আধুনিকায়নের কাজ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য মতে, জমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে ।এটা সম্পন্ন হলেই কাজ শুরু হবে। প্রকল্পের তীর প্রতিরক্ষার কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজের ডিজাইন অনুযায়ী ইস্টিমেট করে জমা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি বেড়েছে। হঠাৎ পানি বাড়াতে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের ২০০ মিটার উজানে অবস্থিত নতুন পাড়া গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। এছাড়া ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে উপজেলার দৌলতদিয়া, ছোট ভাকলা ও দেবগ্রাম ইউনিয়ন। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট, ফেরিঘাটসহ শত শত বসতভিটা।
গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা সুরুজ মন্ডল বলেন, প্রতি বছরই সর্বনাশা পদ্মা তাণ্ডব চালাই লঞ্চঘাট ও ফেরিঘাট এলাকায়। গত বছর বর্ষায় পদ্মার ভাঙনে মসজিদ, বসতভিটাসহ লঞ্চঘাট বিলীন হয়ে যায়। এ বছর আবার বর্ষা মৌসুম আসার আগের শুরু হয়েছে পদ্মার ভাঙন।পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে এবার যতটুকু জমি রয়েছে সেটাও এবার হয়ত নদীগর্ভে চলে যাবে। সরকার শুকনো মৌসুমে ভাঙন রোধে কাজ করলে আমাদের জন্য হয়ত বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু টিকে থাকতো। শুনেছি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কিন্তু তার তো কোনো আভাস পাচ্ছি না। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে আছি, তিনি যা করেন।
কয়েকজন এলাকাবাসী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এ বছর ভাঙন শুরু হলে যতটুকু জমি আছে সেটাও থাকবে না। শুষ্ক মৌসুম গেল। সরকার নদীর পাড় সংরক্ষণের জন্য কোনো স্থায়ী পদক্ষেপই নিলো না। যখন ভাঙন শুরু হয়, তখন কিছু জিও ব্যাগ ফেলে দায়সারা কাজ করে থাকে। সরকারের গাফিলতির কারণে এক সময় মানচিত্র থেকে দৌলতদিয়া ঘাট বিলীন হয়ে যাবে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মকবুল হোসেন বলেন, নৌ-বন্দর আধুনিকায়ন কাজের জন্য দৌলতদিয়া প্রান্তে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন তা এখনো অধিগ্রহণ হয়নি।অধিগ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে। অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতা দূর হলে কাজ শুরু হবে। এছাড়া বুয়েট থেকে নকশার চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে আসেনি। যে কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে।
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ শামীম বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌবন্দরের আধুনিকায়নের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শুরু না হওয়াতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও নকশার পরিবর্তনের কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। নতুন করে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে।
বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় ঘাট আধুনিকায়ন প্রকল্প বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক অনুমোদন হয়েছে। এই প্রকল্পের তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ নিয়ে ২০২০ সালে তাদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এই কাজের ডিজাইন গত মাসে পেয়ে ইস্টিমেট করে প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তাদের নির্দেশনা পেলে মূল কাজ শুরু করতে পারবো।
মীর সামসুজ্জামান/এসপি