নীলফামারীতে অটোরিকশার দ্রুতগতির কারণেই প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু
৮ বছর আগে নীলফামারীর সৈয়দপুরের লিটনের সঙ্গে বিয়ে হয় ডোমারের শারমিনের। দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে আসার পর শারমিন মায়ের বাসাতেই ছিলেন। শনিবার (০১ জুলাই) রাতে প্রসববেদনা উঠলে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক শারমিনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে তাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু পথে মাইক্রোবাসচাপায় মারা যান প্রসূতি শারমিন আক্তার। এ সময় গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নীলফামারী-সৈয়দপুর আঞ্চলিক সড়কের জেলা সদরের সংগলশী ইউনিয়নের শিমুলতলী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
শারমিন আক্তার (২৭) জেলার সৈয়দপুরের কামারপুকুরের মতির মোড় এলাকার রেজাউল ইসলাম লিটনের স্ত্রী। লিটন সৈয়দপুর শহরে দর্জির কাজ করেন। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন শারমিনের সঙ্গে থাকা মেয়ে ইলমা মনি (৪), মা কোহিনুর বেগম (৫০) ও খালাতো ভাই আশরাফুল ইসলাম (২৩)। আহতরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দ্রুতগতির অটোরিকশাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের ওই স্থানে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানকে ধাক্কা দিয়ে উল্টে যায়। এ সময় পেছন দিক থেকে একটি মাইক্রোবাস চাপা দিলে মারা যায় শারমিনসহ ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন শারমিনের সঙ্গে থাকা মেয়ে ইলমা মনি, মা কোহিনূর বেগম ও খালাতো ভাই আশরাফুল ইসলাম। তাদের প্রথমে নীলফামারী আধুনিক হাসপাতালে এবং পরে মনি ও কোহিনূরকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শারমিনের খালাতো ভাই আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চালক ডোমারে গাড়ি ছাড়ার পর থেকেই ফোনে কথা বলছিলেন। আমি সেসময় চালককে বলেছি, গাড়িতে রোগী আছে। সাবধানে চালান। মোবাইল পকেটে রাখেন। তারপর চালক ফোন পকেটে রেখে দিছে। এরপর চালক গাড়ির লাইট আপ-ডাউন করতেছিলেন। আমি বললাম, লাইট ডিপার আর লো করে লাভ নেই। কারণ এত রাতে আপনি লো করলে দূরের গাড়ি চোখে দেখবেন না, লাইটটা হাই করেন। এটা বলার পর চালক লাইট হাই করছে। পরে আমি মাথাটা বের করে সামনে তাকিয়ে দেখি ভ্যান। আমি চালককে বললাম, গাড়ির স্পিড কমান সামনে ভ্যান। এই কথা বলতে বলতে চালক ভ্যানের সঙ্গে অটোরিকশা বাঁধিয়ে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গাড়ির স্পিড কমপক্ষে ৭০-৭৫ ছিল। গাড়ির স্পিড ২০ এ থাকলে সামান্য অটোভ্যানের সঙ্গে লেগে গাড়ি উল্টে যেত না। গাড়িটা উল্টে রাস্তার মাঝে পড়ে গেল। গাড়ির নিচ থেকে দেখা যায়নি মাইক্রোবাস ছিল নাকি ট্রাক। দুর্ঘটনার সময় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলেননি। তিনি শুধু লাইটটা হাই করছেন। আর আমি সামনে ভ্যান কথাটা বলার পর কয়েক সেকেন্ড রেস্ট নিতে পারিনি। ঘটনার পর চালক পালিয়ে যান। আমি আমার বোনকে খুঁজতেছিলাম। পরে আমাকে বলা হলো, তোমার বোনকে পাওয়া গেছে। তোমার খালা ও ভাগনিকে নিয়ে একটা হাসপাতালে যাও। প্রাথমিক চিকিৎসা দাও। পরে রাস্তার লোকজনের সহায়তায় নীলফামারী সদর হাসপাতালে নিয়ে খালা ও ভাগনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে ওদের রংপুর পাঠানোর পর আমার চিকিৎসা করালাম।
তিনি আরও বলেন, চালকের বাড়ি ডোমারে। ওর কোনো খবর নেই। ওর বাড়িতেও কেউ নেই। দুর্ঘটনার জন্য চালক দায়ী। আমি তাকে বার বার গাড়ি আস্তে আস্তে চালাতে বলেছিলাম।
সৈয়দপুর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার খুরশিদ আলম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে নবজাতককে উদ্ধার করেন উত্তরা ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা তাকে সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নবজাতককে যেখানে পাওয়া গেছে, সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে পাওয়া গেছে মায়ের ছিন্নভিন্ন মরদেহ।
সৈয়দপুর ১০০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার নাজমুল হুদা বলেন, রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বাচ্চাটিকে এখানে নিয়ে আসেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বাচ্চাটির মাথায় আঘাত ছিল। শরীর ছিল রক্তাক্ত। তাকে এখানে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়।
শারমিনের লাশের সুরতহাল করা সৈয়দপুর থানার উপ-পরিদর্শক কামাল হোসেন জানান, মাইক্রোবাসের ধাক্কায় প্রসূতির পেট ফেটে গিয়ে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হয়।
শারমিনের বাবা নাজিম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোববার (০২ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে শারমিন ও তার নবজাতকের মরদেহ চিকনমাটি কাচারি পাড়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় পেটে থাকা সন্তানটি বেরিয়ে যায়। মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
শরিফুল ইসলাম/এসপি