তাসলিমার নেতৃত্বে জীবন বদলে গেছে ২০ নারীর
৩০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তাসলিমা আক্তারের। কথা ছিল সংসার করবেন, ছেলেমেয়েদের বড় করে শিক্ষিত বানাবেন। কিন্তু তার কপালে তা সইল না। একদিন হঠাৎ স্বামী দুর্ঘটনায় পতিত হন। এতে অস্ত্রোপচার করে তার দুই পা কেটে ফেলতে হয়। নেমে আসে সংসারে অভাব। এদিকে স্বামীর চিকিৎসা ব্যয়। কূলকিনারা না পেয়ে লেগে পড়েন কাজে।
তাসলিমা শুরু করেন মাঠে কৃষকের কাজ। এ কাজে তিনি একা নন, ১৫ জন বৃদ্ধা ও তরুণীকে সঙ্গে নিয়েছেন। তার নেতৃত্বে গ্রামের ফসলি জমি থেকে অন্যের ধান, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল কেটে ঘরে তুলে দেন তারা। ৩০ বছর ধরে তাসলিমা ও তার দল এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন বেঁচে থাকার তাগিদে।
তাসলিমা আক্তার গোসাইরহাট উপজেলার ইদুলপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড হাফেজ হাওলাদারের স্ত্রী। তার পাঁচ মেয়ে, চার ছেলে।
তাসলিমা ঢাকা পোস্টের কাছে বলেন, আমার স্বামী ৩০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তখন অপারেশন করে তার দুই পা কেটে ফেলা হয়। তারপর থেকে ঘরে বসে থাকেন আমার স্বামী। অভাব শুরু তখন থেকেই। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে জমিতে পুরুষদের সঙ্গে আমিও ধান কাটি, মরিচ ওঠাই, পাট জাগ দিই; কইল, মসুরডাল তুলি। এতে যা পাই, তা দিয়ে সংসার চালাই।
এই এলাকার বেশির ভাগ পরিবারেই দারিদ্র্য গেড়ে বসে। তাই অভাব গোছাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও মাঠে নামতে হয়। তামলিমারাও অভাব দূর করতে তেমন সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, আস্তে আস্তে আমি একটা দল গঠন করি। এই দলে প্রথমে সদস্য ছিল প্রায় ২০ জনের মতো। আমরা পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেছি। এ ছাড়া অনেককেই বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করে ফসলি জমিতে ফসল ওঠানোর জন্য পাঠাতাম। সেখান থেকে যা রোজগার হতো, তা দিয়েই সবাই সংসার চালাত।
সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা পান কি না, এমন প্রশ্নে তাসলিমা বলেন, আমার স্বামী কয়েক বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পান। কিন্তু বর্ষাকালে ঘরের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। বৃষ্টির হলে গুটিসুটি হয়ে থাকি। এ ছাড়া তো আর উপায় নেই। একটি ঘর করার সামর্থ্য আমার নাই। সংসারে ভাতের অভাব। তাই ছেলের বউকেও নিয়ে আসছি মাঠে কাজ করতে।
তাসলিমার সঙ্গে কাজ করতে আসা আনিসা খাতুন (৬৬) বলেন, আমি ২০ বছর ধরে এই দলের সঙ্গে কাজ করি। আমার স্বামী নেই। ছেলে আছে কিন্তু না থাকার মতোই। ভিক্ষা ছাড়া কোনো উপায় না দেখে তাসলিমার সঙ্গে আমি মাঠে কাজ করতে আসি। এখানে যা পাই, তা দিয়েই সংসার চালাই।
এই দলের হাবিবা খানম, সোহানা আক্তার ও বকুল বেগম বলেন, তাদের স্বামী অসুস্থ বা বেকার হওয়ার পর থেকে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কষ্ট করে জীবন চালাতেন। বিকল্প পথ হিসেবে মাঠে কাজ করছেন। যখন যেখানে কাজ পান, দলবেঁধে তারা চলে যান। যেমন আলু তোলার সময় মুন্সিগঞ্জে চলে যান। এভাবেই চলে তাদের জীবনযাপন।
বৃদ্ধা জালাল মাদবর (৬০) বলেন, তাসলিমার স্বামীর বাড়ি আমার বাড়ির পাশে ছিল। তার স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিজেই ছেলে-মেয়ে রেখে সঙ্গে কাজে নেমে পড়েন। মাঠে কাজ করে যা পান, তা দিয়েই সংসার চালান।
গোসাইরহাট উপজেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জসিম উদ্দিন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কিছু জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। তাসলিমা বেশ কয়েকবার আমার কাছে এসেছে ক্ষেতের সরিষা দানাদার হলে তাদের যেন কাটতে দিই। এ ছাড়া এই এলাকার সাত থেকে আটটি বিলের রবি শস্য তার নেতৃত্বে গোলায় তুলে দেওয়া হয়।
এখন মাঠে কাজ নেই বললেই চলে। মাছের ঘের হচ্ছে সব জায়গায়। এতে ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমাদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে। সরকার যদি ফসলি জমিতে মাছের ঘের করার অনুমতি না দেয়, তাহলে আমরা খেয়েপরে বাঁচতে পারি।
তাসলিমা আক্তার
ইদুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাসলিমা বিয়ের পর থেকেই কাজ করেন। বিয়ের কয়েক বছর পর স্বামী দুর্ঘটনায় পা হারান। তার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলায় আলোচনা করে তাসলিমাকে যদি সহযোগিতা করা যায়, সে ব্যবস্থা করে দেব।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদান করে থাকি। যদি সেসব খাতে তাদের জন্য কোনো সুযোগ থাকে, তাহলে অবশ্যই সহযোগিতা করে দেওয়া হবে। পল্লী সমাজসেবা কেন্দ্র ও পল্লী মাতৃকেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে থাকি। যদি তিনি ঋণ নিতে আগ্রহী থাকেন, তাহলে একটি দল করে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা দেব।
গোসাইরহাট উপজেলা মহিলাবিষয়ক (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা ফাতেমা নাহিয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাসলিমা একজন সংগ্রামী নারী। আমরা আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। যদি তারা এ ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নেন, তাহলে সুযোগ করে দেওয়া যাবে। তাসলিমা এলাকার ১৫ থেকে ২০ নারীকে সংগঠিত করে একটি সমিতি করতে পারেন। তাহলে সেই সমিতিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের কাজের ওপর সরকারি আর্থিক সহযোগিতা আসে। এখান থেকে অনুদান নিয়ে তারা বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করতে পারেন বলে জানান তিনি।
এনএ