‘আমার মাছুম কবে এত বড় হইছে, ঘরে মাকে রাখি দেশের জন্য জীবন দিছে’
২০১৭ সালে স্বামীকে হারিয়ে এক ছেলে ও এক মেয়েকে আগলে ধরে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শাহিনুর আক্তার রেখা (৫৩)। পরিবারের হাল ধরতে ২০১৭ সালেই সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে যোগ দেন তার একমাত্র ছেলে আলতাফ হোসেন মাছুম (২৪)। মেয়ে সানজিদা সুলতানা মিম গত বছর অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মাছুম।
গত মঙ্গলবার (১৬ মে) দুপুরে বান্দরবানের রুমায় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণের মুখে নিহত হন আলতাফ হোসেন মাছুম। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল সৈনিক মাছুমের মা।
নিহত সৈনিক আলতাফ হোসেন মাছুম নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার কাদিরহানিফ ইউনিয়নের পূর্ব লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে। তার মৃত্যুতে গ্রামের বাড়িতে নেমেছে শোকের ছায়া। বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। এদিন বেলা ১২টায় মাছুমের নিজ বাড়িতে জানাজা সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, মাছুমের বাবা আবুল কাশেম স্থানীয় রেলগেইট এলাকায় ডেকোরেশনের ব্যবসা করতেন। ২০১৭ সালে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। সেবছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন মাছুম। বাবার মৃত্যুর পর থেকে পরিবারের জীবিকা উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন মাছুম। সবশেষ রমজানের ঈদে ছুটিতে বাড়ি আসেন মাছুম। ছুটি চলাকালীন তার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে ২৬ এপ্রিল বাড়ি থেকে চাকরির উদ্দেশ্যে চলে যান তিনি। মা ও বোনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হতো তার। গত ৩ দিন আগে শেষবারের মত মায়ের সঙ্গে কথা হয় মাছুমের।
বিলাপ করতে করতে শাহিনুর আক্তার রেখা বলেন, ‘ও মাছুম! তুই কবে এত বড় হলি, কবে এত সাহসি হলি? আমি তোকে ছাড়া কেমনে থাকমু! এখন আমারে দেখব কে, আমার মেয়েরে দেখব কে? আমার মাছুম কবে এত বড় হইছে, ঘরে মাকে রাখি দেশের জন্য জীবন দিছে।’
মাছুমের বড় মামা মো. জহির উদ্দিন শাহিন বলেন, আমার ভগ্নিপতির মৃত্যুর পর আমার এ ভাগিনা তার সংসারের হাল ধরেছে। আজ দেশের টানে সেও চলে গেল। আমার বোন আর আমার ভাগ্নি একা হয়ে গেল। তার সঙ্গে আমি হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে প্রতিদিন কথা বলতাম। ও সব সময় আমার ভয়েস মেসেজের রিপ্লাই দিত। আমার শেষ ভয়েসের রিপ্লাই আর দেয়নি। পরে আমি আমার এক খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম তার মৃত্যুর বিষয়টি শুনি।
জহির উদ্দিন শাহিন আরও বলেন, বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। তার মরদেহ রিসিভ করার জন্য আমার ছোট ভাই জসিম উদ্দিন শামীম ও আমার বন্ধু শিপন চট্টগ্রামে আছে। বেলা ১২টায় মাছুমের নিজ বাড়িতে জানাজা শেষে তাকে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএ বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
আইএসপিআর জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন জারুলছড়ি পাড়া নামকস্থানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানা গাঁড়ার খবর আসে। এই সংবাদ পেয়ে সুংসুংপাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে মেজর মনোয়ারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল মঙ্গলবার (১৬ মে) সেখানে যায়। টহল দলটি জারুলছড়ি পাড়ার নিকটস্থ পানির ছড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে আনুমানিক দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে। এতে দুই অফিসার ও দুই সৈনিক আহত হন। আহতদের দ্রুত হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সিএমএইচ চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। চিকিৎসারত অবস্থায় আহত দুই সৈনিক মারা যান। আহত দুই কর্মকর্তা বর্তমানে চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আছেন।
দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ সেনা সদস্যদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে সেনাবাহিনী প্রধান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
হাসিব আল আমিন/আরকে