কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ চাষে ভাগ্য বদল চাষিদের
মেহেরপুরে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজা করে লাভবান হচ্ছেন মৎস্যচাষিরা। চাষিদের ভাগ্য বদলের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে কার্প ফ্যাটেনিং। সাদারণ পদ্ধতির চেয়ে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে তিনগুণ বেশি মাছ উৎপাদন হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছেন শতশত পুকুর মালিক।
মেহেরপুর জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ছোট বড় ৯ হাজার ৬৫ জন মৎস্য চাষি রয়েছে। এ সকল চাষিরা প্রতিবছর ১৩ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করে। জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ১৩ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন। জেলায় পুকুর রয়েছে ৫ হাজার ৩৬৫ টি। এর মধ্যে শুধু গাংনী উপজেলাতেই পুকুর রয়েছে ৩ হাজার ৭১৩টি। মৎস্য চাষি রয়েছে ৪ হাজারের বেশি। উপজেলায় ৬ হাজার ২২১ মেট্রিক টন মাছ শুধুমাত্র গাংনী উপজেলাতেই উৎপাদন হয়ে থাকে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা মেহেরপুরের পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি। জেলায় মোট ১৩৪টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজাকরণ শুরু করে মৎস্যচাষিরা। মাছ চাষের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি চাষিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। আর্থিক সহায়তাসহ পরামর্শ নিয়ে মাছ মোটাতাজাকরে অধিক মুনাফা আয় করে সাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই।
এই পদ্ধতিতে পুকুরে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাছের পোনা দেওয়া হয়। তবে, ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রামের কম ওজনের মাছ পুকুরে দেওয়া হয় না। এক বছর পর যথাযথ পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে মাছ। এ পদ্ধতিতে অল্পদিনে বড় সাইজের মাছ উৎপাদন করা যায়। এই পদ্ধতিতে পাতলা করে মাছ চাষ করতে হয় বলে প্রতি শতাংশে ১৫ থেকে ২০টি পর্যন্ত পোনা ছাড়া হয়।
গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মৎস্যচাষি কিবরিয়া বলেন, ছোট মাছ বিক্রি করে আগে যে পরিমাণ টাকা আয় হতো তাতে আমাদের পুকুর খরচ, মাছের পোনা, খাবার ইত্যাদিতে আয়-ব্যায় সমান হতো। পরে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতির মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শে কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মাছ মোটাতাজাকরণ শুরু করি। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন মৎস উপকরণ দিয়েছে। আমার পুকুরে ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের মাছ রয়েছে। এক বিঘার পুকুরে এ বছর দেড় থেকে ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হবে বলেও আশাবাদি এই মৎস্যচাষি।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মৎস্যচাষি ওবাইদুর রহমান বলেন, বাজারে বড় মাছের চাহিদা অনেকাংশে বেশি। ফলে দামও ভাল। আমার এক বিঘা পুকুরে বড় মাছ চাষ করেছি। ২ কেজির নিচের ওজনের মাছ বিক্রি করলে দাম কম হয়। তাই ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের মাছ বিক্রি করি ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
করমদি গ্রামের হামিদুল ইসলাম ও নাজমুল হক জানান, বাজারে আধা কেজি ওজনের মাছের মূল্য ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। এই ওজনের মাছ মোটাতাজা করে বিক্রি করা হলে অনেক ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। দাম ভালো পাওয়ার পাশপাশি পুকুরে খাবারও কম লাগে।
পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস) মৎস্য কর্মকর্তা সাঈদ-উর রহমান বলেন, বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প প্রভৃতি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই জাতীয় মাছ দ্রুত বড় হয়, রোগাক্রান্ত কম হয়, খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অপরের প্রতিযোগী নয়, পানির সব স্তর থেকে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে এবং এসব মাছ খেতে সুস্বাদু হয়।
তিনি আরও বলেন, সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ করে দেড় বছরে পাঁচ কেজি থেকে ছয় কেজি ওজনের মাছ উৎপাদন করাই কার্প ফ্যাটেনিং বা মাছ মোটাতাজাকরণ। এতে অধিক মুনাফা আয় করে সাবলম্বি হচ্ছেন অনেকেই। মৎস্যচাষিদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পিকেএসএফ এর পক্ষ থেকে পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সমিতি তা বাস্তবায়ন করে চলেছে।
গাংনী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা খন্দকার মো. সহিদুর রহমান বলেন, জেলায় চাহিদা ও উৎপাদন মোটামুটি সমান। বাইরে থেকে মাছের প্রত্যাশা নেই। কার্প ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন সরকারের পাশাপাশি মৎস্যচাষিদের অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে জেলার মৎস্য চাষিদের সহায়তা করে আসছে। পিকেএসএফ এর প্রণোদনা পেয়ে মাছ মোটাতাজাকরণ করে লাভবান হচ্ছে এমন অনেক চাষিই রয়েছে। মৎস্য চাষিদের ভাগ্যবদলে কার্যক্রমটি সহায়ক বলেও জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।
আকতারুজ্জামান/এবিএস