পানিশূন্য তিস্তাপাড়ে কর্মহীন হাজারো জেলে-মাঝির দুর্দিন
পানি নেই প্রমত্তা তিস্তায়। নদীর বিভিন্ন স্থানে পড়ে আছে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। এক সময় জেলেরা দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন তিস্তায় জাল ফেলে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায়। সেই তিস্তা নদী এখন বিস্তীর্ণ বালুচর।
শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে তিস্তার বুক। কোথাও আবার হাঁটু পানি। হেঁটে হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে গরু, পার হচ্ছে গরু-মহিষের গাড়ি। কিছু অংশে পানি থাকলেও নেই মাছের দেখা। এখন তিস্তার তপ্ত বালুচরে সবুজ বিপ্লব। তাই উপার্জন না থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। ঝুঁকির মুখে পড়েছে জেলেদের জীবিকা।
রংপুরের পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। এ দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যারা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন অলস সময় পার করছেন। নদীর ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরাও আছেন হাত গুটিয়ে। খরায় পুড়ে মরা তিস্তাপাড়ে যেন শত শত মাঝি ও মৎস্যজীবীর জীবনে নেমে এসেছে জীবিকার অনিশ্চিয়তা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণ করায় এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা এখন পানি শুকিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। নদীকে ঘিরে কাউনিয়ার শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন সেই নদীতে পানি না থাকায় কাউনিয়া থেকে রাজারহাট, কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারী বন্দর পর্যন্ত নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নৌকার মাঝিরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিপাকে আছেন জেলেরা।
কাউনিয়ার পাঞ্জরভাঙ্গা গ্রামের মাঝি জব্বার, নুরুল, কাদের, জলিল, জাহেদুলের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, প্রায় চার মাস থেকে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে। তখন থেকে নৌকা না চলায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা। সরকারিভাবে তাদের কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা হয় না। অনেকে বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। যারা দিন মজুরির কাজ করতে পারছেন না, তারা বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন। এছাড়া তিস্তা নদীকে ঘিরে শত শত জেলে আছেন চরম বিপাকে।
এক সময় তিস্তা নদীর মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রংপুরসহ আশপাশের জেলাতেও যেত। এখন আর সেই তিস্তায় আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এতে নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসা জেলে পরিবারে যাচ্ছে দুর্দিন।
নিদারুণ কষ্টে থাকা পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের চর গাবুড়া গ্রামের জেলে জহিরুল ইসলাম, তাজির উদ্দিন ও আক্কাস আলীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের মধ্যে তাজির উদ্দিন বলেন, ‘হামার তিস্তা নদী মরি গেইচে। এ্যালা নদীত পানিও নাই, মাছও নাই। একটা সময় হামরা মাছ ধরি জীবিকা নির্বাহ করছি। আর এ্যালা নিজের খাওয়ার মতো মাছও পাওয়া যায় না। মোর মতো হাজার হাজার জেলে এ্যালা কর্মহীন। সরকার হামাক কোনো অনুদানও দেয় না।’
নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মৎস্যজীবীরা বলছেন, তিস্তার ওপর আমাদের জীবিকা। এখন তিস্তা শুকিয়ে গেছে। চারপাশে শুধু বালু আর বালু। যে অল্প অংশে পানি আছে তাতেও মিলছে না মাছ। আমাদের এখন দু-বেলা খাবারের ব্যবস্থাই হচ্ছে না।
রংপুর মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, রংপুরে নদী, বিল ও মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন ১৩ হাজার ৬৩ জন জেলে। আর পুরো জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত মাছচাষি রয়েছে ৩৫ হাজার ৮৫২ জন। যাদের সবাই পুকুরে মাছ চাষ করছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বদরুজ্জামান মানিক বলেন, রংপুরে কর্মহীন জেলেদের জন্য বরাদ্দ না থাকায় দেওয়া যাচ্ছে না অর্থসহায়তা। তবে সরকার যদি এমন কোনো প্রণোদনা বরাদ্দ দেয়, তখন আমরা মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাঝে সেই বরাদ্দ বুঝিয়ে দেব।
এদিকে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ২৩৭ বছর বয়সী নদী তিস্তার জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি কোনো পরিচর্যাই করা হয়নি। তিস্তার নাব্যতা নেই, নেই সামান্য গভীরতা। তিস্তার উপনদী, শাখা-প্রশাখা এখন তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন, সংযোগ হারা। তিস্তার মরণে এর শাখা-প্রশাখা ও উপনদীগুলো হয়েছে গতিহারা। পরিণত হয়েছে জলশূন্য মরা খালে। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটার ব্যাপী তিস্তা অববাহিকার জনপদের ২ কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে মহাদুর্যোগ।
তিনি আরও বলেন, বাড়ছে খরার প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি ক্রমাগত বেসামাল হয়ে উঠছে। তিস্তার ভাঙন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাসে তিস্তাপাড়ের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। খরা, বন্যা ও নদী ভাঙনে তিস্তাপাড়ের ঘরে ঘরে চলছে আহাজারি। নদীনির্ভর জীবন-জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে। হুমকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্রের হার। সারাদেশের ১০টি দরিদ্র জেলার মধ্যে ৬টি রংপুর বিভাগে। দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ হলেও তিস্তাকেন্দ্রিক রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ৪৬ শতাংশ। দরিদ্র বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নদী ভাঙন ও কর্মসংস্থানের অভাব।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর