হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে প্রবাসীর জাঁকজমক বিয়ে
যুক্তরাজ্য থেকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা থাকলেও সেই নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না প্রবাসীরা। উল্টো হোটেল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বিয়ে-শপিংসহ অবাধে চলাফেরা করছেন তারা। সকল সামাজিক অনুষ্ঠানেও তারা যোগ দিচ্ছেন। সম্প্রতি সিলেটের ব্রিটানিয়া হোটেল থেকে ৯ প্রবাসী কোয়ারেন্টাইন থেকে উধাওয়ের পর এসব বিষয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। এমনকি লা ভিস্তা হোটেলে জমজমাট করে বিয়ের আয়োজনও সম্পন্ন হয়েছে কোয়ারেন্টিনে থাকা এক প্রবাসীর।
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ‘স্ট্রেইন’ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দলবেঁধে দেশ ফিরছেন প্রবাসীরা। করোনাভাইরাস নিয়ে সর্তক থাকতে ইতোমধ্যে নানা নির্দেশনাও দিয়েছে সরকার। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কঠোর নজরদারিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বিলেতফেরত প্রবাসীদের সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে সরাসরি তালিকাভুক্ত হোটেল কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। এরপর ৭ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে করোনা পরীক্ষার মাধ্যমে যারা নেগেটিভ হন তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর যারা পজিটিভ হন তাদের সরকারি তত্ত্বাবধানে আইসোলেশনে রাখা হয়।
গত ২০ মার্চ রাতে সিলেটের লামাবাজারে অবস্থিত হোটেল লা-ভিস্তায় কোয়ারেন্টাইন থাকা অবস্থায় লন্ডন ফেরত এক প্রবাসীর বিয়ের খবর পাওয়া গেছে। বাইরে থেকে কনে এনে বিয়ের অনুষ্ঠানও সেরেছেন তারা। এ ঘটনায় সিলেটজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ মার্চ লন্ডন থেকে সিলেটে আসা যাত্রীদের মধ্যে ১১ জনকে সিলেটের লামাবাজারস্থ হোটেল লা-ভিস্তায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এদের মধ্যে দুইজন হলেন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাঙ্গাইল এলাকার বাসিন্দা এক নারী (৪৮) ও তার ছেলে (২৮)। হোটেলের ৪০১ নম্বর ও ৪০৬ নম্বর কক্ষ তার কোয়ারেন্টাইনের জন্য ভাড়া নেন।
কোয়ারেন্টাইন পালন অবস্থায় ২০ মার্চ রাতে ওই হোটেলে জাঁকজমকপূর্ণ করে বিয়ে করলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ওই যুবক। বাইরে থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন উভয়পক্ষের আরও প্রায় ৫০ জন মানুষ। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে খাবার-দাবারও ওই হোটেলে সম্পূর্ণ হয়। শুধু তাই নয়, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাইরে বের হয়ে সিলেট নগরের বিভিন্ন বিপণিবিতানে কেনাকাটাও সারেন ওই যুবকের মা।
বিনিময়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ আর্থিক সুবিধা আদায় করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে নানা টালবাহানা করেন। পরে অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করে তারা।
হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, যেখানে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে প্রবাসীরা যারা কোয়ারেন্টাইনে থাকেন তারাও রাতের খাবারের জন্য উঠেন। যার কারণে সেখানে বেশি মানুষের সমাগম বোঝা যায়।
তবে, মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) রাত ৮টায় লা-ভিস্তা হোটেলের ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানবিক দিক বিবেচনায় এনে আমি চার থেকে পাঁচজনের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে না জানিয়ে বেশি মানুষ নিয়ে চলে আসেন। পরে আমি এসে রাগারাগি করলে তারা বিবাহের কাজ শেষ করে বেরিয়ে যান।’
এই ঘটনায় তারেক আহমদকে হোটেলের ব্যবস্থাপকের পদ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে সিলেট নগরের অধিকাংশ হোটেলের বিরুদ্ধে। এসব হোটেলে অবস্থানরত প্রবাসীরা হোটেল কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে বের হন বাইরে। স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন। ইচ্ছা হলে কেনাকাটাও করেন। যার পুরোটাই হয় হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৮৬১ জন প্রবাসী দেশে এসেছেন। সবশেষ ২২ মার্চ যুক্তরাজ্যে থেকে সিলেটে এসেছন ১৪০ জন প্রবাসী। এরমধ্যে ২৪ জন যাত্রী দুইটি করে টিকা নেওয়ায় তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা সিলেট নগরের বিভিন্ন হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনে রয়েছেন।
তবে যুক্তরাজ্যফেরত এসব প্রবাসীরা কোয়ারান্টাইন মানছে না। তারা হোটেল থেকে গোপনে চলে যাচ্ছেন বাড়িতে। কেউ কেউ হোটেল কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে বাইরে বের হয়ে শপিং থেকে শুরু করে জরুরি কাজকর্মও সারছেন, এমনকি সম্প্রতি এক প্রবাসী কোয়ারেন্টাইনে থেকেও বিয়ে সেরেছেন। নিয়মই না মেনে যে যার মতো করে চলাফেরা শুরু করায় সিলেটে করোনাভাইরাসের নতুন ‘স্ট্রেইন’ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে প্রশাসন এ ব্যাপারে শক্ত নজরদারি রেখেছেন। কোয়ারেন্টাইন ভঙ্গ করার দায়ে ইতোমধ্যে সাতজন প্রবাসীকে জরিমানাও করা হয়েছে। গত রোববার সিলেটের আম্বরখানার হোটেল ব্রিটানিয়া থেকে একই পরিবারের ৯ প্রবাসী কাউকে না জানিয়ে বাড়ি চলে যান। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করলে রাতে ফের তারা হোটেলে ফিরে এসেছেন।
জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (সাধারণ শাখা) শাম্মা লাবিবা অর্ণব বলেন, ‘আমরা এসব বিষয়ে কঠোর হচ্ছি। যারাই কোয়ারান্টাইন ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মন্ডল বলেন, ‘হোটেলে প্রাসীরা কোয়ারেন্টাইন পালন করছেন কি না সেটি নিশ্চিত করবে হোটেল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন। করোনা টেস্টের ফলাফল আসার পূর্ব পর্যন্ত কোনো প্রবাসীর বাইরে বের হওয়ার নিয়ম নেই। কোয়ারান্টাইন যাতে কঠোরভাবে পালন করা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করার কথাও জানান তিনি।’
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফউল্লাহ তাহের বলেন, ‘প্রবাসীরা কীভাবে হোটেল ছেড়ে বাইরে যায় সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব বিষয়ে পুলিশের কোনোও গাফিলাতি থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তুহিন আহমদ/এমএসআর