‘শুধু সকাল-বিকাল বুঝি, দিবস বুঝি না’
মেহেরপুরে কৃষিসহ বিভিন্ন কাজে নারী-পুরুষ সমান ভূমিকা রাখলেও নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বিশেষ করে শ্রম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও কম মজুরি পাওয়ার অভিযোগ তাদের দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশ হলেও এর কোনো সমাধান হয়নি। তবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের চেয়ে নারীরা কম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সোমবার (১লা মে) মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অন্য দিনের মতো আজও সকাল থেকেই কাজে নেমেছেন নারী-পুরুষ সকলেই। মে দিবস কি জানা নেই তাদের। পেটের দায়ে প্রতিদিনই কাজ করতে হয় তাদের। মেহেরপুরের কাথুলী গ্রামের ষাটোর্ধ নারী শ্রমিক আশরাফুন নেছা কাজ করছেন একটি তামাকের গোডাউনে। তার সঙ্গে রয়েছেন নারী-পুরুষ মিলে আরও অন্তত ১০ জন শ্রমিক। তিনি জানান, সকাল সাতটা থেকে বিকেল পর্যন্ত তামাক বাছাইয়ের কাজ করেন। তাকে মজুরি দেওয়া হয় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। অথচ তার সঙ্গের পুরুষ শ্রমিকরা সমপরিমাণ কাজ করে মজুরি পাচ্ছেন ৫০০ টাকা।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত সময়ে কাজ করলে তামাকের বেল প্রতি দেওয়া হয় ৭০ টাকা। মরিচ তোলা, কচু তোলা, আমের বাগান ও ধানের জমিসহ বিভিন্ন কৃষি কাজ করি অন্তত ১০ বছর। তিনি আরও জানান, স্বামী আয়নাল হক বৃদ্ধ হওয়ায় তাকে আর কেউ কাজে নিতে চান না। আশরাফুন নেছার রোজগারের টাকায় চলে তাদের পুরো সংসার।
রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আজিজুলের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বলেন, দেশে সব কিছুর দাম বেড়েছে। পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে কাজ করেও আমাদের মজুরি পুরুষের অর্ধেক। সারাদিন কাজ করে পাই মাত্র ৩০০ টাকা। এ দিয়ে কোনো রকমে সংসারটা বাঁচিয়ে রেখেছি। মজুরি বৃদ্ধির কথা বললে কোনো গৃহস্থ আর কাজে ডাকবে না, তাই যা দিচ্ছে তাতেই কাজ করছি।
গাড়াবাড়িয়া গ্রামের ফজলুল হকের স্ত্রী মানুয়ারা বেগম জানান, আমার বয়স এখন ষাট বছর চলছে। প্রায় ২০ বছর হলো স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব কষ্ট করেছি। কোনো অবলম্বন না পেয়ে কৃষি কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। প্রথমে যখন কাজ শুরু করি তখন মজুরি একেবারেই কম ছিল। সমাজের মানুষও নানা কথা বলতো। এখন কিছুটা মজুরি বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। নারীদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে কেউ খোঁজ খবর নেয় না। আমাদের নিয়ে কারও মাথা চিন্তাও নেই। এই সময়ে ৩০০ টাকায় পেট চলে না।
ধলা গ্রামের শুকুর আলীর স্ত্রী মানছুরা বলেন, গরিবদের আবার দিবস কিরে বাবা? আমরা মুর্খ মানুষ কাজ করে খাই। সকাল থেকে কাজ শুরু করি সন্ধ্যে হলে বাড়ি যাই। শুধু সকাল বিকাল বুঝি। দিবস বুঝি না। বাড়িতে বসে থাকলে আমাদের পেট চলবে না। আমার সংসারে তিনটি মেয়ে। স্বামী বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ কাজে নেয় না। আমাকেই কাজ করে সংসার চালাতে হয়। যা পাচ্ছি তাতেই সন্তুষ্ট থাকি। বেশি কিছু বলতে গেলে কেউ আর কাজে ডাকবে না। তখন খামু কি? সকলেই যখন আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায় কাজ করছে তাহলে আমি বেশি চাইলে দেবে?
শ্রমিক জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা নারী-পুরুষ সকলেই এক সঙ্গে কাজ করি। সকালে এক সঙ্গে কাজে আসি, আবার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরি। আমাদের মজুরি দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। আর নারীদের দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এটা বৈষম্য বটে। এ বৈষম্য দূর করা উচিৎ।
গৃহস্থ রিপন আলী বলেন, আমাদের গোডাউনে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সমান। পুরুষদের প্রতিদিন ৫০০ টাকা ও নারীদের ৩০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। পুরুষ শ্রমিকরা একটু বেশি কাজ করেন, আর নারীরা একটু কম কাজ করেন তাই মজুরিতে পার্থক্য রাখা হয়েছে।
মেহেরপুরের উম্মে ছালমা ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও নারী উদ্যোক্তা উম্মে সালমা সুলতানা বলেন, সর্বক্ষেত্রে নারীরা যখন উন্নয়নে অবদান রাখছে সেই সময়ে মজুরি বৈষম্য তেরি করে নারীদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে। আমি একজন নারী হিসেবে এই বৈষম্য মেনে নিতে পারি না। সমান মজুরি হলে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে এবং মেহেরপুরের কৃষিকে আরও উন্নত করতে নারীরা বড় ভূমিকা রাখবে।
গাংনী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফারহান ইয়াসমিন বলেন, মেহেরপুরের নারীরা অনেক পরিশ্রমী। অসংখ্য নারী রয়েছেন যারা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সংসার ছাড়া হয়ে বাবার সংসারে থাকেন। তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন না করে নিজের কর্ম নিজে করে খাচ্ছেন। এমন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন যারা পুরুষের সমান পরিশ্রম করেন। সামাজ তাদের নানা কথা বললেও আর্থসমাজিক উন্নয়নে নারীদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে শুধু মজুরি বৈষম্য নয়, সব বৈষম্য দূর করলে নারীরা সকল উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আর এর জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নীলা হাপিয়া বলেন, জেলায় অসংখ্য নারী শ্রমিক রয়েছেন। যারা কৃষি, শিল্প, মৎস্যসহ বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। তাদের সংসারে উন্নতির পাশাপাশি একটি স্বনির্ভর দেশ গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কিছুদিন আগেও জেলায় শ্রমিক সংকটে গৃহস্থেরা নানা ভোগান্তিতে পড়তেন। এখন পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে বলে মাঠে ঘাঠে শ্রমিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। সেই সকল নারীদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য তৈরি করা মোটেই কাম্য নয়। আমরা চাই নারীরা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে যেন বঞ্চিত না হন। ন্যায্য পারিশ্রামিক বুঝে পাক। জেলায় নারী শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৫ থেকে ৭ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছে বলে জানান তিনি।
আকতারুজ্জামান/এবিএস