বছর জুড়ে শ্রমিকদের জন্য নানা আয়োজন চলে এই কারখানায়
এক সময় শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ছিল না। মালিকের ইচ্ছানুযায়ী নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হতেন শ্রমিকরা। আজকের এই দিনে আন্দোলন ও জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস আদায় করে শ্রমিক ও তাদের প্রতিনিধিরা। শুধু ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস নয় এখন শ্রমিকদের উজ্জীবিত রাখতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন মালিকরা। এমন পদক্ষেপের অংশ হিসাবে বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানায় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো শ্রমিকদের জন্মদিন পালন করা হয়।
শ্রমিকরা কাজের চাপে অনেকে ভুলেই যান নিজের জন্ম তারিখটি। আর মনে রেখেই বা কি হবে। তারা মনে করতেন জন্মদিন উদযাপন করেন শুধুমাত্র বড়লোকরা। কিন্তু শ্রমিকদের এমন ধারণা পাল্টে দিয়েছে আশুলিয়ার শিমুলতলার স্যামস অ্যাটায়ার লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানা। শ্রমিকদের অজান্তেই জন্মদিন উদযাপনের আয়োজন করেন কারখানা কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্যামস অ্যাটায়ার লিমিটেড নামের পোশাক কারখানাটিতে কাজ করেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের উজ্জীবিত রাখতে বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। এমন পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের জন্মদিন পালন ও জন্মদিন উপলক্ষ্যে গিফট বক্স, সঠিক সময়ে কারখানায় উপস্থিত হওয়া শ্রমিকদের নিয়ে র্যাফেল ড্রসহ নানা পদক্ষেপ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কারখানাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানব সম্পদ) তারিকুল ইসলামের উদ্যোগে শ্রমিকের জন্মদিন উদযাপিত করে আসছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৫ বছর ধরে ওই কারখানায় প্রায় প্রতিদিনই উদযাপন হয় কোনো না কোনো শ্রমিকের জন্মদিন। উৎসব মুখর পরিবেশে এই কারখানার শ্রমিকরা কাজ করেছেন।
স্যামস অ্যাটায়ার লিমিটেড কারখানায় গত ২৯ এপ্রিল একসঙ্গে উদযাপন করা হয় ১০ শ্রমিকের জন্মদিন। এর মধ্যে ছিলেন কারখানার সুইং অপারেটর সারজিনা আক্তার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে আমরা সকাল থেকে টানা ৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। আমরা গরিব মানুষ, জন্মদিন নিয়ে আমার কোনো উৎসাহ ছিল না কোনোদিনই। কল্পনাও ছিল না যে টাকা-পয়সা খরচ করে কেউ আমার জন্মদিন উদযাপন করবে কিংবা কেউ উপহার দেবে। কিন্তু আমার কর্মস্থল এই অনুভূতি পাইয়ে দিয়েছে। এমন কর্মস্থল পেয়ে আমি গর্বিত।
আরেক শ্রমিক মো. সেলিম বলেন, এই কারখানায় কাজ করতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। কারখানা কর্তৃপক্ষ সব শ্রমিকের জন্মদিন পালন করে থাকে। কর্তৃপক্ষ আগের দিন শুধু বলে দেয় আগামীকাল একটু ভাল পোশাক পরে কারখানায় আসতে। পরদিন কারখানায় প্রবেশ করতেই চোখে পরে কর্মস্থল বেলুন ও নানা ধরনের জিনিস দিয়ে সাজানো। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষসহ সহকর্মীরা একসাথে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে কেক কাটেন। এ সময় কারখানার পক্ষ দেওয়া দেওয়া হয় উপহার। সহকর্মীরা নানা উপহার নিয়ে চলে আসেন শুভেচ্ছা জানাতে। কর্মস্থলে এমন আয়োজন আর কোনো পোশাক কারখানায় হয় বলে আমার জানা নেই। এমন কর্মস্থল পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।
কারখানার অপারেশন ম্যানেজার চঞ্চল মজুমদার বলেন, আমরা শ্রমিকদের উজ্জীবিত করতে তাদের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নিই। তথ্য সংরক্ষণ বই থেকে শ্রমিকদের জন্মদিনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যার যেদিন জন্মদিন সেদিনই উৎযাপন করা হয়। কারখানার পক্ষ থেকে তাদের উপহারের ব্যবস্থাও করা হয়। জন্মদিন পালন করা হবে এমন শ্রমিকদের শুধু আমরা আগের দিন জানানো হয় পরের দিন যেন ভাল পোশাক পড়ে কারখানায় আসেন। এ দিন আমরা শ্রমিকদের জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি নেই। শ্রমিকদের কাজের স্থানে তার মাথার ওপর বেলুন টানানো হয়। এছাড়া কেক কেটে তাদের জন্মদিন পালন করা হয়। প্রতি বছরের ১ জানুয়ারিতে আমরা প্রায় ৩৮০ জনের জন্মদিন একসাথে পালন করে থাকি। এতে করে শ্রমিক আর কারখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটা মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকরাও খুশি মনে তাদের সর্বোচ্চ কাজ উপহার দেয়।
স্যামস অ্যাটায়ার লিমিটেডের উৎপাদন কর্মকর্তা (পিএম) আহমেদ রাজীব বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নানাভাবে প্রেরণা দিয়ে থাকে। যে কারণে শ্রমিকরাও মন দিয়ে কাজ করেন। তাদের সাথে ভাল আচরণসহ এমন উদ্যোগের কারণে আমাদের কারখানা ছেড়ে শ্রমিকরা যেতে চান না। কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকরা যেন একটা পরিবার। সেভাবেই শ্রমিকরা এখানে কাজ করেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বলেন, ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেয় ৬ জন শ্রমিক। পরে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। এদিনও পুলিশের গুলিতে ৫ শ্রমিক মারা যায়। এছাড়া আন্দোলন করায় কয়েকজন শ্রমিককে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। সেদিন আন্দোলন গড়ে না তুললে হয়তো আজ এমন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি হতো না। আমি মনে করি সেদিনের শ্রমিকদের প্রাণের বিনিময়ে আজকের এই কর্মপরিবেশ। স্যালুট ও শ্রদ্ধা জানাই জীবন দেওয়া সেই শ্রমিকদের।
ওএফ