রাজশাহীতে ৩ দিনে বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু, অধিকাংশই কৃষক
রাজশাহী বিভাগের চার জেলায় বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বুধ, বৃহস্পতি ও শনিবার জেলার পৃথক স্থানে বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে রাজশাহীতে এক, চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনজন, পাবনায় দুইজন, সিরাজগঞ্জে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
মৌসুমের শুরুতে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে অতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে অবহেলা নয়, সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বৃষ্টির সময় বাইরে নয়, ঘরে অবস্থান করতে হবে। একই সঙ্গে বেশি করে তালের গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে তারা।
জানা গেছে, যারা বজ্রপাতে মারা গেছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই খোলা আকাশের নিচে ছিলেন। কেউ গাছের নিচে কেউ বা কৃষি জমিতে। মূলত খোলা জায়গায় থাকার কারণে এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন তারা। মৃতদের মধ্যে পাঁচজনই কৃষক ছিলেন।
ঢাকা পোস্টের রাজশাহী বিভাগের জেলা প্রতিনিধিরা জানান, গত ২৬ এপ্রিল রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের সাহাপুর ডাইংপাড়া গ্রামের বেলাল উদ্দীনের ছেলে মাসুদ রানা বুলবুল (৪২) ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলীর মোখলেসুর রহমানের ছেলে সাকিবের (৭) মৃত্যু হয়। তার পরদিন বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) শিবগঞ্জে শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের গোপালনগর গ্রামের মো. আব্দুল কাদেরের ছেলে মো. শাহিন (২০) ও একই ইউনিয়নের শরৎনগর গ্রামের মো. হারুন আলীর ছেলে মো. অসিমের (১২) মৃত্যু হয় বজ্রপাতে।
সর্বশেষ শনিবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নের বাগডুমুর গ্রামের নছিম খানের ছেলে আব্দুল মালেক ও একই গ্রামের আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে সোলেমান শেখ, কাজীপুর উপজেলার শুভগাছা ইউনিয়নের যমুনার চরাঞ্চল চর বড়বাড়িয়া গ্রামের মো. শাহিন আলমের স্ত্রী সীমা খাতুনের (২৮) মৃত্যু হয় বজ্রপাতে।
একইদিন বিকেলে বজ্রপাতে পাবনার সুজানগরের আহম্মেদপুরের চরগোবিন্দপুরের আকবর প্রামাণিকের ছেলে মো. মনিরুজ্জামান ও আটঘরিয়ার একদন্ত ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের আব্দুল মজিদ প্রামাণিকের ছেলে এনামুল হকের (২২) মৃত্যু হয়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার কুখুন্ডির বাসিন্দা কৃষক আবদুর রহিম জানান, ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে বিলের (জমির) আশেপাশের বাড়িতে অবস্থান করছি। ঝড় থেমে গেলে আবার কাজে লাগছি।
এ বিষয়ে নওগাঁ পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মাহমুদুন নবী বেলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, তালগাছ বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাটির ক্ষয়রোধ এবং পানির স্তর ধরে রাখতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গত ৩ বছরে নিজস্ব অর্থায়নে নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কে আড়াই লাখ তালবীজ রোপণ করেছি। যেখানে বর্তমানে ১ লখের অধিক তালগাছ দৃশ্যমান। তালগাছ রোপণে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি সচেতন নাগরিক হিসেবে সকলকে এগিয়ে আসা উচিত। তাহলেই দেশ থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার শূন্যে নেমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, ফলজ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছসহ প্রায় ১৫ লাখ গাছ রোপণ করলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাইনি। নিজস্ব অর্থায়নে কাজ করতে গিয়ে এখন আর্থিক সংকটে পড়েছি। আমরা তৃণমূল পর্যায়ে যারা সবটুকু দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করি তাদের জন্য সরকার কিছুই করে না।
বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪০ লাখ তাল গাছ লাগিয়েছে দাবি করে বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য তাল গাছ লাগানোর কথা। সেই সময় থেকে তাল গাছ লাগানো শুরু হয়। বর্তমান সরকারের গত ১৪ বছরে সবচেয় বেশি তালের গাছ লাগানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৯ সালের দিকে রাজশাহী বিভাগের সব জেলা ছাড়াও রংপুর ও দিনাজপুরে তাল গাছ লাগানো হয়। এখনও অনেক তালগাছ বড় হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে আমরা সুফল পাচ্ছি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. জেড. এম. শোয়েব ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত বীক্ষণ শক্তি না থাকার ফলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাত যখন হয় তখন আকাশ থেকে বিদ্যুৎ মাটির দিকে ধেয়ে আসে। বিদ্যুৎ বীক্ষণ না হলেই তখন মানুষ বা গাছের উপর সেটা পড়ে। অনেক সময় বিল্ডিংয়ের উপরেও পড়তে দেখা যায়। বিল্ডিংগুলোতে পড়লে মানুষের খুব বেশি ক্ষতি হয় না। তবে বজ্রপাতের সময় ঘরের বাইরে থাকলে সমস্যাটা বেশি হয়। আর আমাদের দেশে এখনো এর ব্যবস্থা হিসেবে ভালো কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো না। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। বৃষ্টির সময় বাইরে না থেকে ঘরে অবস্থান করতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হায়াত ঢাকা পোস্টকে বলেন, বজ্রপাতে হতাহতদের পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। এছাড়া বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বিভিন্ন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে। আর জনসচেতনতার সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরউল্লাহ এনডিসি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে বজ্রপাতে মারা যাওয়া অধিকাংশই কৃষক। তারা মূলত বৃষ্টিপাত বা ঝড়ের সময় জমিতে থাকেন, এ জন্য বজ্রপাতে তাদেরই মৃত্যু বেশি হয়। এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার।
শাহিনুল আশিক/এসকেডি