কফি ও কাজুবাদামে রংপুরে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি
শখের বশে কফি চাষ শুরু করেছিলেন মোখলেছুর রহমান। এতে বাজিমাত করার সঙ্গে পেয়েছেন সফলতাও। মাত্র পাঁচ বছরেই আয় করেছেন কয়েক লাখ টাকা। বর্তমানে তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই ঝুঁকছেন কফি চাষে। মোখলেছুরের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় ৫২টি বাগানে চাষ হচ্ছে কফি।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার গোয়াল বাড়ি এলাকার বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান। তিনি এমএ ডিগ্রি অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এলএলডি গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ে চাকরি করতেন।
অনলাইনে কফি চাষ সম্পর্কিত ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হন মোখলেছুর রহমান। এরপর শখ করে কফি চাষ শুরু করেন। কক্সবাজারের জাহানারা গ্রিন অ্যাগ্রো থেকে উন্নত ফলনশীল এ্যারাবিয়ান জাতের চারা সংগ্রহ করেন তিনি। ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর বাড়ির পাশে রাস্তার ধারের ২০ শতক জমিতে ৪৫০টি চারা রোপণের মধ্য দিয়ে শুরু করেন কফি চাষ। সে সময় তার খরচ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
নিয়মিত চর্চায় দীর্ঘ ১৮ মাস পর কফি গাছে ফুল আসে। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ফল আসে। ২০২০ সালে বাগান থেকে ২৫ কেজি গ্রিন বিন সংগ্রহ করেন মোখলেছুর, যা বিক্রি করে ছয় হাজার টাকা আয় করেন। ২০২১ সালে এসে বাগান থেকে ৭০ কেজি গ্রিন বিন পৌনে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করেন। গত বছরে মোখলেছুর রহমান বাগান থেকে ১০৭ কেজি গ্রিন বিন তিন লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। তার বাগান থেকে আরও গ্রিন সংগ্রহ করা যাবে।
বর্তমানে মোখলেছুর রহমান কফি বাগানের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে চারাও উৎপাদন করছেন। গত বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন তিনি। নার্সারিতে আরও চারা রয়েছে। কফি বাগান থেকে ফল সংগ্রহ করে ম্যানুয়ালে প্রসেসিং করে কফির ডাস্ট তৈরি করেন মোখলেছুর। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাজারে এই কফি বিক্রি করেন।
এখন তার বাগানের পাশে গড়ে তুলেছেন রংপুর কফি ক্লাব। যেখানে বিকেল হলেই কফি আড্ডায় মেতে উঠেন সববয়সী মানুষ। অর্থকরী ফসল হিসেবে কফি চাষের মাধ্যমে রংপুরের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চান মোখলেছুর রহমান।
এদিকে ব্যক্তি উদ্যোগে মোখলেছুর রহমান তারাগঞ্জে প্রথম কফি চাষ করলেও এবার রংপুর জেলায় তা সরকারি উদ্যোগে বিস্তৃত হচ্ছে। জেলার বদরগঞ্জ ও পীরগঞ্জ উপজেলাতে ৯২টি বাগানে চাষ হচ্ছে কফি এবং কাজুবাদাম।
পীরগঞ্জের বড়আলমপুর ইউনিয়নের কৃষক মাঈনুল ইসলাম তার জমিতে কফির পাশাপাশি গড়েছেন কাজুবাদামের বাগান। সঙ্গে দুই বাগানে সাথি ফসল হিসেবে রেখেছেন কুলগাছও।
কৃষক মাঈনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ৫০ শতক করে দুটি উঁচু জমি আছে। এ জমিতে আগে আখ চাষ করতাম। বর্তমানে সেখানের একটিতে কফি এবং আরেক জমিতে কাজুবাদাম চাষ করছি। আমার কফি ও কাজুবাদামের বাগানে ভালো ফুল এসেছে। আশা করছি ভালো ফলন মিলবে।
শুধু রংপুরের মোখছেলুর বা মাঈনুলই নয়, সারা দেশে এমন অনেকেই কফি চাষে ভাগ্যবদলের স্বপ্ন বুনছেন। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, সঠিকভাবে কফি চাষ করতে পারলে ভালো ফলন হয়, আর বিক্রি করে লাভবানও হওয়া যায়। তারা আশা করছেন, একদিন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও কফি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
পীরগঞ্জ কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বড়আলমপুর ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে দারুণভাবে বেড়ে ওঠা কাজুবাদাম এবং অন্যান্য ফলের গাছগুলি প্রকল্পের চারপাশে এক মনোরম ও নয়নাভিরাম পরিবেশ তৈরি করেছে, যা এলাকাটিকে নজরকাড়া একরূপে সজ্জিত করার পাশাপাশি সুন্দর সবুজায়ন অঞ্চলে পরিণত করেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাদেকুজ্জামান সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুকূল আবহাওয়া ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে কৃষকদের মাঝে উন্নতমানের চারা সরবরাহের কারণে কফি ও কাজুবাদাম চারা আশানুরূপভাবে বেড়ে উঠছে। পাশাপাশি কৃষকদের আমরা ওই বাগানগুলোকে সাথি ফসলের পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ কফি ও কাজুবাদাম গাছ একটু ছায়াযুক্ত স্থান বেশি পছন্দ করে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের সার্বিক পরামর্শে কৃষকদের মাঝে যে আশার সঞ্চার করেছে আগামীতে এই অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদামের চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এ ক্ষেত্রে পীরগঞ্জ কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শ অব্যাহত থাকবে।
তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোখলেছুর রহমান ব্যক্তি উদ্যোগে কফি চাষ করছেন। আমরা তাকে আরও বড় পরিসরে চাষাবাদ বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছি। চেষ্টা করেছি তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করার। যখন যা প্রয়োজন কারিগরি সহযোগিতার, তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারিভাবে রংপুর জেলার দুটি উপজেলায় কফি চাষ শুরু হয়েছে। তবে তারাগঞ্জে সরকারিভাবে শুরু হয়নি।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুরের বদরগঞ্জ ও পীরগঞ্জ উপজেলায় কফি ও কাজুবাদাম চাষে কৃষকদের চারা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছি। সরকারি এ উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হলে কফি ও কাজুবাদাম চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা নিজেদের আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন বলে আশা করছি।
তিনি জানান, জেলার বদরগঞ্জ ও পীরগঞ্জে সরকারি উদ্যোগে কফি ও কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে। দেড় বছর আগে রোপণ করা গাছগুলোতে ইতোমধ্যে ফুল এসেছে। আগামী বছরের মধ্যে সবগুলো গাছেই ফুল আসবে এবং ফলন ভালো হবে। পীরগঞ্জে ৫৮টি এবং বদরগঞ্জে ১৫টি কফি বাগান রয়েছে। একেকটি বাগান দেড় বিঘা করে জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। কফির বাগান ছাড়া পীরগঞ্জে ১৩টি এবং বদরগঞ্জে ৬টি কাজুবাদামের বাগান রয়েছে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন ২০১৯ সালে ৯৭২ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৮২ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৫৬২ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ১ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন। অন্যদিকে কফির উৎপাদন ২০২০ সালে ৫৫ দশমিক ৭২ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ৫৮ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৬২ মেট্রিক টন। আর কাজুবাদাম আমদানি করা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৩৩০ মেট্রিক টন, ২০১৯ সালে ৫১০ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৪ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ২ হাজার ৩০ দশমিক ৫৬ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৪৩১ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন। কফি আমদানি ২০১৮ সালে ৮৫৫ মেট্রিক টন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৩ হাজার ১০২টি কাজুবাদাম জাত ও প্রযুক্তি প্রর্দশনী, ২ হাজার ৭৪৪টি কফি জাত ও প্রযুক্তি প্রর্দশনী দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ২৫০ একর জমিতে ২২২টি কাজুবাদামের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী, ১৬৪টি কফি চাষের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
বিশ্বব্যাপী কাজুবাদাম ও কফির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শহীদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশেও এর বাজার বাড়ছে। দেশের পাহাড়ি এলাকায় কাজুবাদাম ও কফি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্য সরকারের নির্দেশনায় প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১২ লাখ কাজুবাদাম ও কফির চারাসহ অন্য উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে বর্তমান মৌসুমে আরও ১০ লাখ চারা বিতরণ করা হবে। বাগান স্থাপনে প্রকল্প থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে কফি ও কাজুবাদামের বাজার ‘প্রায় দেড় হাজার’ কোটি টাকার। প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হলে কাজুবাদামের উৎপাদন ২ হাজার মেট্রিক টন থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব। আর কফি বিন উৎপাদন ৮ হাজার মেট্রিক টনে গিয়ে দাঁড়াবে।
এমজেইউ