জাহাজশূন্য হয়ে পড়েছে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর
যমুনা, পদ্মা, মেঘনা ও বড়াল নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে উঠেছে অনেক ডুবোচর। ফলে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে রাসায়নিক সার, কয়লা, পাথর, সিমেন্ট ও জ্বালানি তেলবাহী কার্গো জাহাজ সম্পূর্ণ লোড নিয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে ভিড়তে পারছে না। এতে তিন মাস ধরে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর জাহাজশূন্য হয়ে অচল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি কর্মহীন হয়ে পড়েছে বন্দরের পাঁচ শতাধিক শ্রমিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঘাবাড়ী-চট্টগ্রাম-মোংলা নৌবন্দর রুটের বিভিন্ন পয়েন্টে ১০ থেকে ১২ ফুট ড্রাফটের পানির চাহিদা থাকলেও আছে সাড়ে মাত্র সাত ফুট ড্রাফট। ফলে চট্টগ্রাম ও মোংলা নৌবন্দর থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরগামী কার্গো জাহাজগুলো পরিপূর্ণ লোড নিয়ে নৌবন্দরে যেতে পারছে না। পাটুরিয়া ও নগরবাড়ির আগেই লাইটারেজের মাধ্যমে জাহাজ থেকে অর্ধেক মাল আনলোড করে বেড়া, নগরবাড়ী ও যশোরের নওয়াপাড়া ঘাটে খালাস করছে পরিবহন ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ। এতে জাহাজশূন্য হয়ে অচল হয়ে পড়েছে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর।
অপরদিকে, নগরবাড়ী, বেড়া ও যশোরের নওয়াপাড়া থেকে ১০ চাকা অথবা ১৬ চাকার ট্রাকে করে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের বাফার গুদামে আনা হচ্ছে সার। এরপর তা সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায়। এতে চরম ক্ষতি হচ্ছে মহাসড়কের। এমনকি, ভরা সেচ মৌসুমেও উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ১৪টি বাফার গুদামে যথাসময়ে সার সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে চলতি ইরি ও বোরো আবাদে চাহিদা অনুযায়ী রাসায়নিক সার সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। এ সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এ নৌরুটের ডুবোচরগুলো অপসারণ করে সঠিক মাত্রার ড্রাফট ফিরিয়ে আনতে বিআইডব্লিউটিএ-এর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কৃষক ও শ্রমিকরা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর না দেওয়ায় লোকসান গুনছে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের ইজারাদাররা। গত তিন মাস ধরে বন্দরে জাহাজ না আসায় অনেকটাই দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন তারা। সেই সঙ্গে পণ্যবাহী জাহাজ না আসায় নৌবন্দরে কর্মরত প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিক দুলাল সরদার, আলমগীর হোসেন, ওমর ফারুক ও জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ সময় তারা জানান, গত ৪০ বছরেও বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এমন জাহাজশূন্য হয়নি। ডুবোচর ও নাব্যতা সংকটের কারণে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসছে না। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের পাঁচ শতাধিক শ্রমিক। বন্দরের দুই একটি স্থানের সার ট্রাকে তুলে দিয়ে যে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে কোনোরকমে চলছে তাদের সংসার।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিক প্রতিনিধি আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোহনগঞ্জ, মোল্লার চর, ব্যাটারির চর, পাটুরিয়া, নিকলি ও দাসকান্দি এলাকায় নদীর পানি কম থাকায় পূর্ণলোডে পণ্যবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে রাসায়নিক সার পরিবহনের চার ঠিকাদার কোম্পানি কুষ্টিয়া ও নওয়াপাড়া নিয়ে জাহাজগুলো আনলোড করছে। এরপর সেখান থেকে ১৬ চাকার ট্রাকে করে তা সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলে। ফলে জাহাজশূন্য হয়ে অচল হয়ে পড়েছে বন্দরটি।
তিনি আরও বলেন, কোটি কোটি টাকা দিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাট ইজারা নিয়েছি। জাহাজ না আসায় আমাদের প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ কারণে, দ্রুত নৌপথ সচল করতে বিআইডব্লিউটিএ’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এ ব্যাপারে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএ‘র উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের নৌপথে কোনো নাব্যতা সংকট নেই। এখানে আট থেকে ১০ ফুট পানির ড্রাফট রয়েছে। এটা দ্বিতীয় শ্রেণির বন্দর। ফলে এ বন্দর চ্যানেলে নিয়ম অনুযায়ী সাত থেকে আট ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলার কথা। কিন্তু নিয়ম অমান্য করে সেখানে ১০ থেকে ১২ ফুট ড্রাফটের জাহাজ নিয়ে গেলে তো সমস্যা হবেই। তবে, এ বন্দরটি প্রথম শ্রেণির বন্দরে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। এটি হয়ে গেলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের বাফার গুদামের ইনচার্জ হারুন আর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে জাহাজ না আসার বিষয়টি আমার জানা নেই। ওটা আমার অধীনে নয়। আমার অধীনে থাকা বাঘাবাড়ী বাফার গুদামে চাহিদা অনুযায়ী সার মজুদ রয়েছে। এখান থেকে শুধু পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় সার সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে অবস্থিত পরিবহন ঠিকাদার কোম্পানি বাল্ক ইন্টারন্যাশনাল ও দেশবন্ধুর উত্তরাঞ্চল প্রধান শাহান শাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়ার দাসকান্দি এলাকায় নাব্যতা সংকট সবচেয়ে বেশি। এখান থেকে লাইটারেজে করে প্রতি বস্তা সার বাঘাবাড়ী বন্দরে নিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এতে আমার কোম্পানির লোকসান হয়।
এ সময় তিনি আরও বলেন, এই নাব্যতা সংকট নিরসনে আমরা সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি। কিন্তু গত ২০ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বাঘাবাড়ী বন্দরের এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
শুভ কুমার ঘোষ/এবিএস