কৃষি মাঠ থেকে সফল ফ্রিল্যান্সার শাহীন, মাসে আয় ৫ লাখ
এক প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের ঘরে জন্ম শাহিনুর রহমান শাহীনের। মাঠে কাজ করতে করতে স্কুল যাওয়ার স্বপ্ন প্রায় শেষ হয়ে যেতে বসেছিল তার। নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। বাবার সঙ্গে কৃষি কাজের পাশাপাশি স্কুলে যেতেন শাহীন। অনেকবার তার পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে কৃষির মাঠ থেকে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন ফ্রিলান্সিং মার্কেটপ্লেস ‘আপওয়ার্ক’ এর একজন প্রথম সারির ফ্রিল্যান্সার। ঘরে বসেই তিনি মাসে আয় করছেন ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার।
এই সফল ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। জানা যায়, শাহীনের বাড়ি পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর বড়দাপ এলাকার। তিনি ওই এলাকার কৃষক দবিরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে। তার দুই বোনের মধ্যে এক বোন প্রতিবন্ধী। তার আয় দিয়েই মা-বাবা, দুই বোনসহ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলছে পুরো পরিবার। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শাহীন ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে ব্যস্ত। তার টিমে কাজ করছেন কয়েকজন কলেজ শিক্ষার্থী। কাজের ফাঁকেই তার সঙ্গে কথা হয়।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় শাহীন বলেন, বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করতে হতো আমাকে। বাবা লেখাপড়া করাতে চাইতেন না। তিনি চাইতেন, আমি যেন তার সঙ্গে শুধু কৃষি কাজ করি। কিন্তু পড়ালেখায় আগ্রহ থাকায় সব বাধা কাটিয়ে স্কুল-কলেজ শেষ করে আজ সফল ফ্রিল্যান্সার হয়ে উঠেছি।
যেভাবে ফ্রিল্যান্সার হওয়া শুরু
২০১৬ সালে বগুড়ার এক বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট আইআইটিবিতে ডিপ্লোমায় ভর্তি হই। তখন স্মার্টফোনে ফেসবুক-ইউটিউবে অনলাইনে ইনকামের অনেক পোস্ট দেখে ফ্রিল্যান্সিং করার স্বপ্ন জাগে। কিন্তু ল্যাপটপ বা কম্পিউটার না থাকায় শুধু স্মার্টফোন দিয়ে সেটা সম্ভব হত না। শুধু ফোনেই ইউটিউব দেখে শেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ল্যাপটপ ছাড়া কিছুই হচ্ছিল না। পরের বছর বাড়িতে এসে বাবাকে ল্যাপটপ কিনে দিতে চাপ দিলাম। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। টিউশনি করে কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম। সেই টাকার সঙ্গে বাড়ি থেকে কিছু টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কিনে দিতে বললাম। অনলাইন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বাবা ল্যাপটপ কিনে দিতে চাচ্ছিলেন না।
কম্পিউটার কিনে না দেওয়ায় বাড়িতে একদিন ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। পনেরো বিশ দিন কলেজেও যাইনি। এ কারণে সে সেমিস্টারে বড় অঙ্কের জরিমানাও গুণতে হয়েছিল আমাকে। পরে অবস্থা বুঝতে পেরে মা ও বড় বোনের কথায় বাবা কিস্তিতে একটা ল্যাপটপ কিনে দিলেন। ল্যাপটপ পেয়ে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এটা দিয়ে কিছু করে দেখাব আমি। পরে টিউশনির টাকা দিয়ে ল্যাপটপের মাসিক কিস্তি শোধ করি।
এরপর শুরু করলাম অনলাইনে উপার্জন করা শেখা উপায়। প্রথমে কিছুই বুঝতাম না। স্মার্টফোনে যা করতাম তা ল্যাপটপে করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পারতাম না। কারণ ল্যাপটপ কিনতে পারলেও চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। রুমমেট সৌরভের কাছ থেকে ল্যাপটপ চালানো শিখলাম। কীভাবে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করতে হয়, গুগল ও ইউটিউবে সার্চ করে অনলাইন থেকে কীভাবে আয় করা যায় তা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকি। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় সব কিছু শিখে ফেললাম। কিন্তু কাজ পাচ্ছিলাম না। যারা পারত তাদের কাছে মেসেজ দিতাম। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেলাম না।
এভাবে কেটে গেল দুই বছর। কাজ না পেলেও হাল ছাড়িনি। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের স্কিল শিখতে থাকলাম এবং সেগুলো চর্চা করতাম। আপওয়ার্ক বাংলাদেশ (Upwork Bangladesh) এর ইফতার পার্টি, বিটপা কনফারেন্সে আমাকে যেতে বললেও লজ্জায় যেতাম না। কারণ আমি তো কাজ পেতাম না। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কাজ পাই কিনা, কী জবাব দেব, এই ভয়েই যেতাম না। কিন্তু সেসব কনফারেন্সে যেতে খুব ইচ্ছে হতো। তাওহিদ রহমান, কাজী মামুন, শরিফ শাহজাহান, মুজাহিদুল ইসলাম ও সুমন সাহা ভাইদের লাইভগুলো দেখে মনে হতো এরকম যদি আমিও হতে পারতাম।
ভিডিও দেখে যা কাজ করে আয় হতো তা এমবি কিনতেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু ধৈর্য হারা হইনি। কাজ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। ভেবেছিলাম পারব না। কত রাত না ঘুমিয়ে একটি কাজের জন্য অপেক্ষা করেছি। অবশেষে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঘণ্টা চুক্তিতে একটি কাজ পেলাম। প্রতি ঘণ্টার রেট ছিল ৩ ডলার। আমার কাজের কোয়ালিটি চেক করতে ক্লাইন্ট আমাকে ১ ঘণ্টা কাজ করতে দিয়েছিল। এক ঘণ্টায় কাজ করে তা ডেলিভারি দিলেও সেটি চেক করতে তারা প্রায় ১২ দিন সময় নেয়।
সেই ৩ ডলার দিয়েই শুরু হয় যাত্রা। ১১-১২ দিন পর ক্লাইন্ট জানায় কাজের কোয়ালিটি ভালো হওয়ায় তারা আরও কাজ দিতে চান। এটা শুনে কাজে স্পৃহা বেড়ে গেল বহুগুণে। আনন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কাজ শুরু করলাম। ওই ক্লাইন্টের ৩০ ঘণ্টা কাজ করে ৯০ ডলার ইনকাম করেছিলাম। তারা আমাকে ভালো ফিডব্যাক দেয়।
শাহীন জানান, ইংরেজিতে এক্সপার্ট না হওয়ায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাকে। অনেক ক্লাইন্ট ভিডিও কলে মিটিং করতে গিয়ে ইংলিশ বলতে না পারায় কাজ দিত না। এরপর ইংরেজিতে পারদর্শী হতে পড়া শুরু করলেন তিনি। চর্চা করতে শুরু করলেন ইউটিউব দেখে। এখন ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন শাহীন। এভাবেই একটা-দুইটা করে কাজ পেতে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে কাজ করার অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে। সেগুলো তার প্রোফাইলকে ভারি করে। এখন পর্যন্ত সাড়ে তিনশ'র বেশি ক্লাইন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এক লাখ ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। শাহীন এখন ওয়ার্ল্ড এর টপ মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক এর একজন টপ রেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার। ঘরে বসেই মাসে তার আয় হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলার।
শাহীনের ফ্রিল্যান্সিং আইটি প্রতিষ্ঠান
শাহীনের ফ্রিল্যান্সারের আয়ে বদলে গেছে তার বাড়িঘর। আটোয়ারিতে প্যারিস সিনেমা হলের পিছনে গড়ে তুলেছেন সুন্দর বাড়ি। তিনি বাড়িতে গড়ে তুলেছেন টেকোরেক্স নামের ফ্রিল্যান্সিং আইটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে এলাকার আগ্রহী স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা এখানে ফ্রিল্যান্সিং শিখে উপার্জন করছে।
কথা হয় শাহীনের প্রতিষ্ঠানের ভর্তি হওয়া মোকসেদুর রহমান, পলিটেকনিকের সেভেন সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আরমান আলী, এইচএসসি পড়ুয়া সাথী আক্তার ও ফয়সাল ইসলামের সঙ্গে। তারা জানান, ইন্টারনেটে কীভাবে আয় করা যায় তার কাজ শেখা তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এজন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় ছুটোছুটি করেছেন। পরে এলাকায় শাহীনের সাফল্য দেখে তারা এখানে এসে কাজ শিখতে শুরু করেন। এখন কাজ শিখে শাহীনের টিমে কাজ করছেন তারা।
শাহীনের বড় বোন শারমিন আক্তার জানান, শাহীন ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। তাই আমার স্বামীর চাকরির সুবাধে তাকে পড়াশোনার জন্য বগুড়ায় নিয়ে যাই। বলতে গেলে তার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে আমার ও মায়ের সাপোর্ট ছিল। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি বাড়িতে চলে আসে। শাহীন এখন ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করছে, আমাদেরকে চালাচ্ছে এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে।
তার বাবা দবিরুল ইসলাম বলেন, প্রথমে ছেলেকে পড়াতে চাইতাম না। চাইতাম কৃষিকাজ করুক। কিন্তু শাহীনের পড়ালেখার প্রতি খুব আগ্রহ থাকায় সে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। ওর সাফল্য আমাকে চমকে দিয়েছে। খুব ভালো লাগছে। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।
ফ্রিল্যান্সার শাহীন নতুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, নতুনদের বিষয়ে বলতে চাই, আপনি এসএসসি, এইচএসসি কিংবা স্নাতক পাস হয়ে থাকলে ঘরে বসে না থেকে ফ্রিল্যান্সিং কাজ শিখুন। চাকরির পেছনে না ছুটে কাজের পেছনে ছুটুন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে আয়ের চেষ্টা করুন। পড়ালেখার পাশাপাশি যদি দৈনিক এক ঘণ্টা এ কাজে ব্যয় করতে পারেন, তাহলে বছরে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫ ঘণ্টা ব্যয় করে কাজটি শিখে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবেন। তাই শিক্ষিত বেকারদের চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অনলাইন প্লাটফর্মে এসে কাজ শিখুন। এ কাজই আপনার নতুন পথ তৈরি করে দেবে। সাফল্যের পথ তৈরি করে দেবে।
বগুড়ার আইআইটিবি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সবুর শাহ লোটাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহীন মেধাবী ছাত্র ছিল। দূরন্তপনা ও আয় রোজগারের প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক ছিল তার। আমরা চেষ্টা করেছি তাকে গাইডলাইন দিয়ে এগিয়ে যেতে। এখন সে তার মেধা দিয়ে ভালো কিছু করছে। জেনে খুব ভালো লাগছে। ও আরও এগিয়ে যাক দোয়া করি।
আরকে