হাওরে আতঙ্কের আরেক নাম ‘বজ্রপাত’
বিশ্বের সবচেয়ে বজ্রপ্রবণ এলাকার মধ্যে অন্যতম সুনামগঞ্জ। হাওর অধ্যুষিত এ জেলায় বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাত যেন আতঙ্কের আরেক নাম। ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে আসে ভয়ঙ্কর বজ্রপাত। এতে প্রতিবছর প্রাণ হারান হাওরের কৃষক ও জেলেরা। বাদ যায় না গৃহপালিত পশুগুলোও।
বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণার পর বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করার প্রকল্প নেয় সরকার। তবে সুনামগঞ্জে এ বছর ১২টি উপজেলার মধ্যে ৬ উপজেলায় মাত্র ২৪টি বজ্র নিরোধক দণ্ড বসানো হয়েছে। হাওর এলাকার চাহিদার তুলনায় যা অপ্রতুল। হাওরে নিরাপত্তার স্বার্থে বেশি করে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
জানা যায়, বছরের এই সময় থেকে সুনামগঞ্জে শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত। চলে মে-জুন মাস পর্যন্ত। এই কয়েকমাস সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায়, বজ্রপাতে স্বজন হারানোদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে চারপাশ। হাওরে কাজ করার সময় বজ্রপাত শুরু হলে দিশেহারা হয়ে পড়েন কৃষক-জেলে।
আরও পড়ুন >> অস্বাভাবিক বজ্রপাত, নদীমাতৃক দেশই অভিশাপ
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর গ্রামের কৃষাণী আফিয়া বেগম বলেন, কয়েকদিন আগে বাইরে রান্না করার সময় আমাদের এলাকার এক নারী বজ্রপাতে মারা যান। এরকম প্রতি বছর মানুষ মারা যাচ্ছে।
জয়তুন নামে আরেক নারী বলেন, হাওরে যখন আমাদের পুরুষেরা কাজে থাকে বেশিরভাগ সময় তখন বজ্রপাত শুরু হয়। আমাদের মনে সব সময় আতঙ্ক কাজ করে।
২০১৭ সালে নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ এলাকায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৫টিরও বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে এখানে। যা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বজ্রপ্রবণ এলাকা। ভারতের খাসিয়া ও মেঘালয় পাহাড়ে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আকাশে মেঘ জমে থাকে। স্তরীভূত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ওই এলাকার পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতের সংখ্যাও বেশি হয়ে থাকে। আর তাই তখন বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হলে কোনো না কোনো হাওরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। প্রতি বছর মার্চ মাস হলো বোরো ধান চাষের সময়। ধানখেতে কাজ করার সময় বেশি সংখ্যক মানুষ, গবাদি পশু বজ্রপাতে মারা যায়। সেই সঙ্গে বহু মানুষ আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার তথ্যমতে গত পাঁচ বছরে বজ্রপাতে নিহত ৬০ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন তারা। অনুদান ও তালিকার বাইরে থাকা বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণ।
বৃদ্ধ সাফায়াত আলী বলেন, আমরা ছোট থাকতে এতো মানুষ মরতে শুনিনি। এখন বজ্রপাত হলেই কেউ না কেউ মারা যায়। হাওরে ধান কাটার সময় এই বিপদ আরও বেশি দেখা দেয়।
জাহাঙ্গীর আলম নামে এক স্থানীয় বলেন, বজ্র নিরোধ করতে আমাদের এলাকায় একটি টাওয়ার দেওয়া হয়েছে। এতে কিছু মানুষ নিরাপদ থাকলেও পুরো হাওর অরক্ষিত। এই টাওয়ার পুরো হাওরে বসাতে পারলে আমরা নিরাপদে ধান কাটতে ও মাছ ধরতে পারতাম।
দিন দিন হাওরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ বছর জেলার ৬টি উপজেলায় ২৪টি আধুনিক বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করেছে সরকার। ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপিত প্রতিটি দণ্ডের আশপাশের ৩শ ফুট ভেতরে বজ্রপাত সংঘটিত হলে তা টেনে এনে মাটিতে পাঠিয়ে দেবে দণ্ডের মাথায় লাগানো লাইটিং এরেস্টার নামক যন্ত্রটি। শুধু প্রতিরোধ নয়, বছরে ওই স্থানে সর্বমোট কতটি বজ্রপাত হয়েছে তা গণনা করেও রাখবে তুরস্ক থেকে আমদানিকৃত এই যন্ত্রটি।
বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন প্রকল্পের প্রকৌশলী সালাউদ্দিন বললেন, সুনামগঞ্জে এ বছর আমরা ২৪টি লাইটেনিং এরেস্টার স্থাপন করেছি। এই দণ্ড এর ৩শ ফুট এরিয়ার ভেতরে কোনো বজ্র সংগঠিত হলে তা টেনে মাটিতে পাঠিয়ে দেবে। একই সঙ্গে ওই স্থানে মোট কতটি বজ্রপাত সংগঠিত হয়েছে তা গণনা করে রাখবে। মানুষের পাশাপাশি গরু-ছাগলের প্রাণও বাঁচবে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জ দেশের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী এলাকা। হাওর এলাকায় হওয়ায় এখানে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেশি হয়। বজ্র নিরোধক একটি দণ্ড মাত্র ৩০০ ফুট জায়গার নিরাপত্তা দিচ্ছে। এটির পরিধি কিভাবে বাড়ানো যায় পাশাপাশি আরও বেশি দণ্ড স্থাপনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করব।
সোহানুর রহমান সোহান/আরকে