শিশুটিকে নিজের কাছে রাখতেই নাটক সাজান স্কুলশিক্ষিকা
নয় বছরের শিশুটিকে নিজের কাছে রাখতে শিশুটির বাবা ও সৎ ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে তাদের নির্যাতন করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ইসরাত জাহান ওরফে লিপি (৪৪) নামের এক স্কুলশিক্ষিকা।
ইসরাত জাহান ওরফে লিপি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
সোমবার (২৭ মার্চ) দুপুরে ফরিদপুর পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান।
তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে বাবা ও ছেলেকে মারধরের একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই ভিডিও ফুটেজে যেসব বক্তব্য রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো ‘আজ রেজিস্ট্রি করে দিয়ে যাবি, তোর মেয়েকে ম্যাডামের কাছে রাখবি।’ এ থেকে বুঝা যায় যারা সেদিন বাবা ও ছেলেকে আটকে অমানুষিক নির্যাতন করেছে তারা ওই শিক্ষিকার পরিচিত এবং তার ইঙ্গিতেই করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাবা ও ভাইদের কাছ থেকে শিশুটিকে নিজের জিম্মায় নেওয়ার জন্য শিশুটিকে ‘বাবা ও সৎ ভাই ধর্ষণ করেছে’ এই তথ্য প্রচার করে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করে বাবা ও ছেলের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, গত তিন মাস আগে ওই শিশুটি (৯) আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে নিঃসন্তান স্কুলশিক্ষিকা ইসরাত জাহান তাকে খুব আদর করতেন। শিশুটি জন্মের সময় তার মাকে হারিয়েছে। এজন্য তার প্রতি শিক্ষিকার মমতা তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে ওই শিক্ষিকা শিশুটির বাবা ও সৎ ভাইকে না জানিয়ে তাকে ফরিদপুরের বাসায় নিয়ে রাখতেন। এ বিষয়টি শিশুটির বাবা ও ভাই মেনে নিতে পারেনি।
গত ১৭ মার্চ শিশুটিকে শিক্ষিকার ফরিদপুরের বাসা থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার নাম করে ওই শিক্ষিকা শিশুটির বাবা ও ভাইকে আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেকে আনেন। এরপর এক নারীসহ স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বাবা ও ছেলেকে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে নির্যাতন করে। নির্যাতনের একটি ভিডিও গত ২৫ মার্চ রাতে ভাইরাল হওয়ায় বিষয়টি সকলের নজরে আসে।
ভাইরাল ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ওই শিশুটির সৎ ভাই রাজন মৃধা (১৫) একটি চেয়ারে বসে আছে। সেখানে প্রথমে এক নারী তাকে নামতা বলতে বলেন। ভিডিওতে ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের সময় আমরা নামতা পড়তাম, এক অক্কে এক আমায় চেয়ে দেখ।’ এরপরই রাজনকে চেয়ার থেকে নামিয়ে কয়েক ব্যক্তি কাঠের লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করেন। সেখানে নেতৃত্ব দেন এক নারী। ওই নারীকে ভিডিওতে বেশ খোশ মেজাজে দেখা যায়। এরপর আট থেকে দশজন ব্যক্তি রাজন ও তার বাবাকে বেদম মারধর করেন।
এ ঘটনায় গত ২০ মার্চ ওই শিশুটির বাবাকে দিয়ে দুটি মামলা করানো হয়। একটি মামলা বাবা ও ছেলেকে মারধরের অভিযোগে। আরেকটি মামলা করা হয় ছেলের বিরুদ্ধে সৎ বোনকে ধর্ষণের অভিযোগে।
বাবাকে দিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে সৎ বোনকে ধর্ষণের অভিযোগের মামলার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ওই শিশু প্রথমে বাবা ও সৎ ভাইকে ও পরে বাবাকে বাদ দিয়ে শুধু সৎ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করে। তবে মামলা হওয়ার পর শিশুটিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে শিশুটি জানায় তাকে কেউ ধর্ষণ করেনি। পরে আদালতেও শিশুটি একই কথা বলে।
পুলিশ সুপার বলেন, ওই শিশুটিকে যা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রথমে তাই বলেছে। পরবর্তীতে সত্য কথা বলেছে। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে শিশুটি তার বাবা ও ভাইয়ের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়নি, বরং শিশুটিকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এ নাটক সাজিয়েছেন ওই স্কুলশিক্ষিকা।
নির্যাতনের শিকার দুজন হলেন- কামারখালী ইউনিয়নের রউফনগর গ্রামের ইয়ামিন মৃধা রাজু (৪০) ও তার সৎ ছেলে রাজন মৃধা (১৫)। নদীভাঙনে ভিটামাটি হারিয়ে প্রায় ১২ বছর তারা মাঝকান্দি গ্রামে মো. সালাম শেখের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছেন।
এ ব্যাপারে শিশুটির বাবা ইয়ামিন মৃধা বলেন, আমার নয় বছর বয়সী মেয়ে আড়ুয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ইসরাত জাহান নিঃসন্তান। তিনি আমার মেয়েকে লোভ দেখিয়ে তার কাছে নিয়ে রাখতে চান। তিনি অনেক দিন ধরে এই চেষ্টা করছেন। এর আগেও তিনি আমার মেয়েকে আমাদের না জানিয়ে তার ফরিদপুর শহরের বাসায় নিয়ে গেছেন। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেয়েকে তার বাসায় পেয়েছি।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে স্কুলশিক্ষিকা ইসরাত জাহান জানান, শিশুটিকে তিনি ফরিদপুরের বাসায় নিয়ে যাননি। শিশুটি একাই মধুখালী থেকে তার বাসায় চলে যেত। এছাড়া তিনি শিশুটিকে কিছু শিখিয়ে দেননি। বাবা ও ছেলেকে বিদ্যালয়ে কারা মেরেছে তা তার জানা নেই বলে দাবি করেন ইসরাত জাহান।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী সার্কেল) সুমন কর জানান, বাবা ও ছেলেকে মারধরের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে জামিনে রয়েছে।
ওই বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি দশরথ চন্দ্র দাস বলেন, ভিডিওতে মারধরের নির্মমতা দেখে আতকে উঠেছি। প্রধান শিক্ষক আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি। আমি পরে ভিডিও দেখেছি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কবিরুজ্জামান জানান, ১৭ তারিখে তার বিদ্যালয়ে এ জাতীয় একটি ঘটনা ঘটেছে তা তিনি তখন জানতেন না। পরে ভিডিও দেখে জানতে পেরেছেন। এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
এ বিষয়ে মধুখালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মহিউদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং অপর দুই উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নাসিমা আক্তার ও কানিজ ফাতেমাকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ২৯ মার্চ এ কমিটি ওই বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করবে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জহির হোসেন/এমজেইউ