‘আগে তিন কেজি খেজুর কিনলেও এখন কিনতে হচ্ছে এক কেজি’
রমজান উপলক্ষ্যে শুরু হয়েছে কেনাকাটা। বাড়তি দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না ক্রেতাদের। নিম্ন আয়ের মানুষেরা মাছ-মাংস কেনার আশা ছেড়ে শাক-সবজি কিনেও স্বস্তি পাচ্ছেন না। এদিকে কারসাজি করে পণ্যের দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা পকেটে ভরছেন। সরকার সংশ্লিষ্টরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সাধারণ ক্রেতাদের ওপর দিয়ে বাড়তি দামের ধকল যাচ্ছে। এতে রমজান এলেই সিন্ডিকেট চক্রের দামের চাপ পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে।
মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে রংপুর সিটি বাজারে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসছেন বোরহান কবির। মুদিখানার দোকান থেকে ছোলা, চিনি, তেল, ডাল ও বেসন কিনেছেন ঠিকই। কিন্তু সবকিছুর বাড়তি দামের জন্য কমিয়েছেন কেনাকাটা।
বাড়ি থেকে দুটি ব্যাগ সঙ্গে আনলেও একটি ব্যাগ না ভরতেই হিসেবের টাকা শেষ দাবি করে বোরহান কবির বলেন, রমজানে মাসে তো চলতে হবে। আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল, যখন ইচ্ছে কিনতাম। কিন্তু এখন তো বাজার অনিয়ন্ত্রিত। দাম কমে না, শুধু মাসে মাসে বেড়েই চলছে। কিন্তু আমার বেতন তো মাসে মাসে বাড়ছে না। আগে তিন কেজি খেজুর কিনলেও এখন এক কেজি খেজুর কিনতে হচ্ছে। সবকিছুর দাম বেশি তাই অল্প অল্প করে কিনতে হচ্ছে।
বাজার ঘুরে রমজান মাসের জন্য আদা, পেঁয়াজ ও রসুন কিনছেন ইকবাল সুমন। তবে দাম নিয়ে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি। সামান্য বেতনে স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত রয়েছেন। প্রতিদিন বাজারের খবরাখবর রাখেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের মতো তারও কপালে চিন্তার ভাঁজ।
ইকবাল সুমন বলেন, যে ব্যাগে করে খরচাপাতি নিয়ে যাব, সেটারও দাম বেড়েছে। সবকিছুর দামই বাড়তি, কী কিনব? রমজানে যা প্রয়োজনীয় তা কিনতেও এখন ভাবতে হচ্ছে। আবার না কিনেও উপায় নেই। আজকে যা কম দামে পাচ্ছি, কাল-পরশু তো দাম বেশি হতে পারে। এ কারণে সাধ্যের মধ্যে কিনতে চেষ্টা করছি।
ইফতারের তালিকায় অন্যান্য খাবারের সঙ্গে খেজুর সবার প্রিয়। প্রায় ৩০ ধরনের খেজুরের মধ্যে ৮ থেকে ১০ ধরনের খেজুরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। গত বছর প্রতি কেজি আজওয়া খেজুর বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকা। চলতি বছর সেই খেজুর পাইকারিতে ৭০০ টাকা আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি খেজুরে দাম বেড়েছে এক টাকারও বেশি। কেজি হিসেবে যা অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকট, এলসি জটিলতা ও বিদেশি ফলে আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় খরচ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, ফলে দামও দ্বিগুণ। তাদের দাবি, খুচরা পর্যায়ে সব খেজুরের দামই ৫০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিটি বাজারের ফল ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যবসার আর আগের মতো নেই। আগে আড়ৎদারকে ১ লাখ টাকা দিলে তিন-চার লাখ টাকার পণ্য হাতে পেতাম। কিন্তু এখন যে পরিমাণ টাকা, সেই পরিমাণ পণ্য। বাকি দিতে চায় না, আমদানি কম, খরচ বেশি, এলসি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে এবার খেজুরের দাম বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
এবার এখনও স্বস্তি আছে ছোলা নিয়ে। আগের ৮৫ টাকা কেজিতেই বিক্রি হচ্ছে ছোলা। তবে সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনি। বেসন বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর রমজানের আগে বেচাকেনা বাড়লেও এবার চিত্রটা ভিন্ন। বাজারে ক্রেতাদের ভিড় কম। আর সবাই কম পরিমাণে কিনছেন।
রমজানে বিভিন্ন মাংসের চাহিদা থাকে বেশি। এ সপ্তাহে গরুর মাংস ৬৭০-৭০০ টাকা কেজি এবং ছাগলের মাংস ৯০০-১০০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। আর আগের চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। কেজিতে গুণতে হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। আর ব্যবসায়ীরা বললেন, মুরগির সরবরাহ রমজানে বাড়বে। তাই দাম না কমলেও আর বাড়বে না।
রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে ব্রয়লার ২৫০-২৬০ টাকা, পাকিস্তানি মুরগি (সোনালী) ৩৫০-৩৬০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৫৪০-৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর পাকিস্তানি লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকায়।
ধনেপাতা, ফুলকপি ও মটরশুঁটিসহ কিছু সবজির দামও ঊর্ধ্বমুখী। তবে কমেছে রসুন ও সজনে ডাঁটার দাম। মাছ, চাল, ডাল ও তেলের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সজনে ডাঁটা ১২০-১৪০ টাকা, প্রতি কেজি টমেটো ২৫-৩০ টাকা, গাজর ২৫-৩০ টাকা, শসা ২৫-৩০ টাকা, চিকন বেগুন ২০ টাকা, গোল বেগুন ৩০ টাকা, পেঁপে ১৫-২০ টাকা, লেবু হালি ১৫-২০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০ টাকা, শুকনো মরিচ ৪৫০-৫০০ টাকা, লাউ প্রতি পিচ আকারভেদে ৩০-৪০ টাকা, ধনেপাতার কেজি ৭০-৮০ টাকা, কাঁচকলা হালি ২৫-৩০ টাকা, প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়া ৩০-৩৫ টাকা, শিম ২৫-৩০ টাকা, বাঁধাকপি ১০ টাকা পিস এবং ফুলকপি ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে আদা ১৩০-১৪০ টাকা এবং রসুন ১০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সব ধরনের শাকের আঁটি পাওয়া যাচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। মিষ্টি আলু ৩৫-৪০ টাকা, পটল ৫৫-৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০-৮০ টাকা এবং মটরশুঁটি ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে নতুন কার্ডিনাল আলু ১৫-১৬ টাকা, শিল ও ঝাউ আলু ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। আর দেশি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকা এবং আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজি দরে।
রংপুর সিটি বাজারের সবজি বিক্রেতা শাহিন মিয়া বলেন, কোনো কিছুরই দাম কমছে না। বরং বাড়ছে। তাছাড়া আমদানির ওপর নির্ভর করে সবজির বাজার ওঠানামা করছে।
খুচরা বাজারে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৮৭ টাকা, দুই লিটার ৩৭৪ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৬০-১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্বর্ণা চাল গত সপ্তাহের মতোই ৫০-৫২ টাকা, পাইজাম ৫৪-৫৫ টাকা, বিআর২৮ ৬০-৬৫ টাকা, মিনিকেট ৭৫-৭৮ টাকা ও নাজিরশাইল ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
খোলা দেশি চিনি ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেট আটার দাম কমে ৬৫-৬৮ টাকা ও খোলা আটা ৫৮-৬০ টাকা, ছোলা ৯৫-১০০ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লবণ ৪০ টাকা, মসুর মোটা ১০০ টাকা, মসুর চিকন ১৩০ টাকা, বুট ডাল ১০০ টাকা, খেসারি ডাল ৮৫ টাকা, মুগ ডাল ১৪০ টাকা কেজি।
এদিকে রমজান উপলক্ষে সিটি বাজার তদারকি করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ সময় কাঁচাবাজারসহ মাছ, মাংস, ফল বিক্রেতাদের দাম না বাড়ানোসহ পানি দিয়ে ওজন বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি না করতে পরামর্শ দেন তারা। বেশকিছু দোকানদারকে পণ্যের মূল্য তালিকা না রাখায় সতর্ক করার পাশাপাশি বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগে জরিমানাও করা হয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করলে বাজারে কোনো সংকট হবে না। আর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। তাই কারসাজি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া সংকট এড়াতে ভোক্তাকে একসঙ্গে এক সপ্তাহের বেশি বাজার না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে