পাটখড়ির ছাইয়ে আয় ২৫ কোটি টাকা
পাটকে বাংলাদেশের সোনালী আঁশ বলা হয়। এক সময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের এতো বেশি অবদান ছিল যে এটা কৃষকের কাছে স্বর্ণের মত ছিল। তবে মাঝখানে এই পাট কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে উঠেছিল। এখন আবার পাটের সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। কাঁচা পাট রফতানির পাশাপাশি পাটজাত বিভিন্ন দ্রব্যও বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এই মুহূর্তে পাট রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
তবে পাট বা পাটজাত দ্রব্য নয় সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে পাটখড়ির ছাই বা ছাই থেকে তৈরি কার্বন। পাটখড়ি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় চারকোল পাউডার বা কার্বন। এ কার্বন চীনসহ কয়েকটি দেশে রফতানি হয়। কার্বন থেকে তৈরি হয় কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী পণ্য প্রভূতি।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের জয়নগরে গড়ে উঠেছে দুটি কার্বন ফ্যাক্টরি। একটি গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরি অপরটি কে এইচ কার্বন ফ্যাক্টরি। ময়না ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে মধুমতির পাড়ে রুইজানি গ্রামে রয়েছে আরও একটি কার্বন ফ্যাক্টরি। এটি ইমপিগনো প্রাইভেট কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিনটি ফ্যাক্টরিই উৎপাদনে রয়েছে। ফ্যাক্টরিগুলোতে কার্বন উৎপাদনের কাঁচামাল কয়েক হাজার মণ পাটখড়ি মজুত করা হয়েছে। পাটখড়ি প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রতি বছর কমপক্ষে ছয় মাস এ ফ্যাক্টরিগুলো চালু থাকে। জুলাই-আগস্ট মাস থেকে পাটখড়ি ওঠা শুরু হয়। পাটখড়ি ওঠার পর অক্টোবর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত মিলগুলো উৎপাদনে থাকে। বাকি ৫-৬ মাস বন্ধ থাকে।
জয়নগরের গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরি এ অঞ্চলের প্রথম ফ্যাক্টরি। চাইনিজরাই মূলত এটি প্রায় ৮/১০ বছর আগে গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে হাতবদল হয়ে বর্তমানে এটির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা হীরু মুন্সি।
তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলা পাট চাষের জন্য বিখ্যাত। প্রচুর পরিমাণ পাট উৎপাদন হয় এখানে। কার্বনের কাঁচামাল পাটখড়ি এবং শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ায় এ অঞ্চলে কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, বোয়ালমারী অঞ্চলের তিনটি ছাড়াও পাশের মধুখালী, আলফাডাঙ্গা, সালথায় একাধিক কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এ এলাকার কার্বন চীনে রফতানি হলেও চীনের বাইরে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, তাইওয়ানসহ আরও কিছু দেশে পাটখড়ির কার্বনের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরির পাশেই গড়ে উঠেছে কে এইচ কার্বন ফ্যাক্টরি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার রুহুল আমিন ২০১৬ সালে জমি লিজ নিয়ে এই ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৯ সালে মিলটি কার্বন উৎপাদন শুরু করে।
ফ্যাক্টরির দায়িত্বে থাকা সবুজ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মিল চালু থাকে। প্রতিদিন চারশ মণ পাটখড়ির প্রয়োজন হয়। প্রতি মণ পাটখড়ি থেকে প্রায় ১০ কেজি চারকোল পাউডার বা কার্বন উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি কার্বন ৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। পাটখড়ি ২২০ টাকা মণ দরে ক্রয় করা হয়। তাদের ফ্যাক্টরিতে ২০ জন লোক কাজ করেন বলেও তিনি জানান।
রুইজানিতে অবস্থিত কার্বন ফ্যাক্টরিটি ২০১৬ সালে ইমপিগনো প্রাইভেট লিমিডেট স্থাপন করে। পরের বছরই ফ্যাক্টরিটি উৎপাদনে যায়। এ কারখানার ম্যানেজার খোরশেদ আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, কার্বনের ৯৫ ভাগ আমদানি করে চীন। বাকি ৫ ভাগ অন্যান্য দেশ আমদানি করে। তারা চারকোল পাউডার বা কার্বন থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী পণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও খেতের সারসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে।
তিনি আরও জানান, পাটখড়ি বিশেষ চুল্লিতে লোড করে আগুনে জ্বালানো হয়। এভাবে ১০-১২ ঘণ্টা জ্বালানোর পর চুল্লিটির মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাতে কোনোভাবে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে চারদিন রাখার পর সেখান থেকে বের করে ক্র্যাশিং করে কার্বন প্যাক করা হয়।
খোরশেদ আলম জানান, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি চালানে সাড়ে ১২ কেজির ৬ হাজার বস্তা কার্বন উৎপাদন করা হয়। এই পরিমাণ কার্বন উৎপাদনে পাটখড়ি লাগে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ মণ। প্রতি চার কেজি পাটখড়ি থেকে এক কেজি কার্বন উৎপাদন হয়। কার্বনের বিক্রি বা সরবরাহ ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে হয়ে থাকে এবং সব লেনদেনই ডলারে হয়। তারা প্রতি মণ পাটখড়ি বর্তমানে ২৫০ টাকা করে ক্রয় করেন। করোনার কারণে ব্যবসা একটু মন্দা।
আনুমানিক হিসাব দিয়ে খোরশেদ আলম জানান, প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা তাদের লাভ থাকে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা এবং লাভবান ব্যবসা বলে উপজেলার গুনবহা গ্রামের কাজী আজিজুল হকের ছেলে কাজী সাকলায়েন আজিজ রথি গুনবহা মাঠে একটি কার্বন ফ্যাক্টরি স্থাপনের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কথা বলে এলাকার কিছু লোকজন তা বন্ধ করে দেন।
এদিকে এই ব্যবসায় মালিকরা লাভ করলেও কার্বন ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে ফ্যাক্টরির ভেতরে যারা কাজ করেন তাদের মুখে মাস্ক নেই, মাথায় মাথাল নেই। নেই বিশেষ কোনো পোশাক। শ্রমিকদের সারা শরীর ছাই আর ময়লায় মাখামাখি থাকে। শ্বাসকষ্টসহ নানা রকম রোগের ঝুঁকি রয়েছে এ সব শ্রমিকের। চুল্লির পাইপ ছোট হওয়ায় ফ্যাক্টরির পাশের ফসলি জমির ক্ষতি করছে ছাই। কে এইচ এবং ইমপিগনো কার্বন ফ্যাক্টরির ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্রসহ সব কাগজপত্র আছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। তবে কেউ তা দেখাননি। গোল্ডেন কার্বন ফ্যাক্টরির কাগজপত্র নেই বলে জানা গেছে।
মধুখালীতে জিনসিং ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড নামে গড়ে উঠেছে একটি কার্বন ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরিটির মালিক চীনা নাগরিক ওয়াং চুয়াং লি। ২০১৩ সালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন উপজেলার দিঘলিয়া নামক স্থানে ফ্যাক্টরি স্থাপন করে তিনি কার্বন উৎপাদন শুরু করেন। ১৮টি চুল্লির মাধ্যমে পাটখড়ি পুড়িয়ে কার্বন তৈরি করা হয়।
ফ্যাক্টরিটির মালিক চীনা নাগরিক ওয়াং চুয়াং লি বাংলায় কথা বলতে না পারায় কথা হয় ফ্যাক্টরিটির ম্যানেজার আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ফ্যাক্টরিটির উৎপাদন শুরু হয়। শুরু থেকেই আমি এখানে দায়িত্ব পালন করছি। ১৮টি চুল্লি রয়েছে, প্রতিদিন ৩০ টন পাটকাঠির প্রয়োজন হয়। ভালোই চলছিল, কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা মন্দা।
কার্বন ফ্যাক্টরির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিসিএমইএ) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে চারকোল রফতানি হয় চার হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন। প্রতি টনের মূল্য ছিল ৭০০ ডলার। এ হিসেবে চারকোল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪ কোটি ৮১ লাখ ৭২ হাজার টাকার সমান।
অন্যদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৯-২০১০ সালে বিদেশে চারকোল রফতানি শুরু হয়। এ খাত থেকে বছরে ৩২ কোটি ২৫ লাখ ডলার রফতানি আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব পেতে পারে ৪০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।
সাতৈর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কার্বন ফ্যাক্টরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয় আর্থসামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে। পাটখড়ি রান্নার জ্বালানি আর বেড়া দেওয়ার কাজে ছাড়া আর কিছুতে লাগতো না। এখন পাটখড়ি বিক্রি করে কৃষক টাকা পাচ্ছে। পাশাপাশি অনেকে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এ কারণে বেকার সমস্যাও হ্রাস পাচ্ছে।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলার ভেতর যে কোনো প্রকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা শিল্প সহায়ক প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করা হবে। তবে সেসব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হবে। তারা যেন পরিবেশ বা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিছু না করে।
আরএআর