‘আমার বাপ আর আসবে না, আমি কারে রান্না করে খাওয়াব’
মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় নিহত খুলনার শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজার (৪৪) বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতের মা নুরুন্নাহার কাঁদতে কাঁদতে ছেলের জন্য বিলাপ করছেন।
খুলনার সোনাডাঙ্গা হাজী তমিজউদ্দীন সড়কের ৬২ নম্বর বাড়ির তৃতীয়তলায় বসবাস করেন তারা। নিহত রাজা ওই এলাকার শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে। ঢাকায় পূবালী ব্যাংক মুগলটলি ব্রাঞ্চের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন তিনি।
নিহতের মা নুরুন্নাহার বিলাপ করে বলেন, 'ভোর ৫টায় গাড়িতে করে গেছে। আমি জানি না কোন গাড়িতে। আমি ফোন দিই, কিন্তু ছেলে ফোন ধরে না। বার বার ফোন দিয়েছি, ধরে না। পরে একজন বলে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ১৫-১৬ জন মারা গেছে, শুনে আমি আর নেই। আমার বাপের সঙ্গে আমি রাতে কথা বলেছি আব্বা কোন সময় যাবা? ছেলে বললো আম্মা আমি ভোর ৫টার সময় যাব'।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বাপ যদি রাত্রিরে যেত, আমার বাপের কিচ্ছু হতো না। আমার বাপ রাত্রিরে গেল না ক্যা? এখন প্রতি বৃহস্পতিবার কে আসবে? আমার বাপ আর আসবে না, আমি কারে রান্না করে খাওয়াব।
নিহত রাজার একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ আল মুমিন রাফিও দাদা মোহাম্মদ আলী ও দাদি নুরুন্নাহারের সঙ্গে কাঁদছেন। রোববার (১৯ মার্চ) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে নিহত রাজার বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।
আরও পড়ুন : বাবা এখন ফিরবেন মেয়ের লাশ নিয়ে
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জানান, রোববার ভোর ৫টার দিকে সোনাডাঙ্গা থেকে ইমাদ পরিবহনে নিজ কর্মস্থল পূবালী ব্যাংক ঢাকা মুগলটলি ব্রাঞ্চের উদ্দেশ্যে রওনা দেন রাজা। মাদারীপুর শিবচর এক্সপ্রেসওয়েতে বাসটির দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সংবাদ পেয়ে পরিবারের সদস্যরা তার মরদেহ আনতে শিবচরে যান। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার অফিস শেষে ছুটিতে খুলনায় বাড়ি চলে আসতেন। আবার ছুটি শেষে খুলনা থেকে শনিবার রাতে অথবা রোববার সকালে বাসে করে ঢাকায় নিজ কর্মস্থলে যেতেন।
নিহত রাজার মামা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগ্নে রাজা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি গাড়ি খুব দ্রুত চলছিল। চালকের খুব তাড়াহুড়ো ছিল। যার কারণে এ দুর্ঘটনা হয়েছে।
খুলনা থেকে ইমাদ পরিবহনের যাত্রীদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন রাজা ছাড়াও মারা গেছেন, নগরীর টুটপাড়া আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকুজ্জামান লিংকন, খুলনার সাউথ সেন্ট্রাল রোডের চিত্ত রঞ্জন ঘোষের ছেলে চিন্ময় প্রসূন ঘোষ, ডুমুরিয়ার পরিমল সাদুখা ছেলে মহাদেব কুমার সাধু খাঁ ও রাশেদ আলী। এর মধ্যে রাশেদ আলীর বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটায় হলেও তিনি খুলনায় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।
ডাচ-বাংলা ব্যাংক খুলনার ম্যানেজার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে ইমাদ পরিবহনে করে সকালে অফিসের জন্য ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ঢাকা নয়াবাজার ব্রাঞ্চের ডেপুটি ম্যানেজার মহাদেব কুমার ও ঢাকা হেড অফিসের সিনিয়র কর্মকর্তা রাশেদ আলী রওনা দেন। শিবচরে দুর্ঘটনায় তারা দুজনই মারা গেছেন। তারা দুজন আগে খুলনা শাখায় কর্মরত ছিলেন।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া নিহত আশফাকুজ্জামান লিংকনের ছোট ভাই ইশরাকুজ্জামান বলেন, রোববার সকালে ঢাকায় যাওয়ার জন্য দুই ভাই বাড়ি থেকে এক সঙ্গে বের হই। আমি গোপালগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে ট্রেনে করে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারি ইমাদ পরিবহনের ২০৩ নং নম্বর কোচটি মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। সেখানে দুর্ঘটনায় আমার ভাইও মারা গেছেন।
রাজবাড়ী মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ম্যানেজার ইশরাকুজ্জামান আরও বলেন, ভাই আশফাকুজ্জামান লিংকন পেশায় প্রথম শ্রেণির একজন ঠিকাদার। ঢাকা ও খুলনায় কাজ করতেন। আমি রাজবাড়ী ও ভাই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য খুব ভোরে বাড়ি থেকে বের হই। আমার পরের আসনে ভাই বসেছিলেন। শুরু থেকে গাড়িটির গতিবেগ বেশি ছিল। প্রথমদিকে চালককে দ্রুত চালানোর জন্য নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা চালক কর্ণপাত করেননি। ভোর ৬টার দিকে গাড়িটি গোপালগঞ্জে পৌঁছায়। সেখান নামার পূর্বে ‘আমার ভাই ভালো থাকিস’ বলে শেষবার বিদায় দিয়েছিল।
মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় রোববার সকালে ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের বাসটি খাদে পড়ে যায়। রোববার ভোর ৪টার দিকে খুলনার ফুলতলা থেকে বাসটি ছাড়ে। পরে ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে ইমাদ পরিবহনের বাসটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাসটির চালক সকালে পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারায়। বাসটি রেলিং ভেঙে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এ ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে।
মোহাম্মদ মিলন/আরকে