‘মেলা লোকে খারাপ খারাপ কাথা কহিচে, মুই কোনো শুনুনি’
পারিবারিকভাবে ২২ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল নুরজাহান বেগমের (৪১)। স্বামীর আয় কম থাকায় অভাব অনটনে দিন কাটতো। কয়েক বছর যেতে না যেতেই বেড়ে যায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা। আয় না বাড়লেও বাড়তে থাকে ব্যয়। চার বছর আগে শরীরে টিউমার ধরা পরে তার। যা পুঁজি ছিল সব শেষ হয়ে যায় চিকিৎসা করাতে। বেড়ে যায় সংসারে অভাব অনটন ।
নুরজাহান বেগমের চার মেয়ে। নেই নিজস্ব বসতভিটা। ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন সরকারি জায়গায়। স্বামীর হকারির আয়ে সংসারের খরচ জোটানো দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তার। কোনো উপায় না পেয়ে ভাঙা একটি ভ্যানে করে শুরু করেন সংগ্রামী জীবন। দুই বছর ধরে প্রতিদিন ভ্যানে করে ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাচ্ছেন নুরজাহান।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নের মুথরাপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী নুরজাহান বেগম। সমাজের সব কটু কথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভ্যানে করে ঝালমুড়িসহ নানা মুখরোচক খাবার বিক্রি করেন তিনি। তার এই সংগ্রামী জীবনকে সাধুবাদ জানিয়ে সরকার ও বিত্তবানের তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে এলাকাবাসী৷
স্কুলছাত্র জিসান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলে, প্রতিদিন নুরজাহান চাচির কাছ থেকে আমি ঝালমুড়ি কিনে খাই। তার ঝালমুড়ি অনেক স্বাদ। তবে তিনি অনেক কষ্ট করেন। ভ্যানে করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন আবার নিয়ে যান। উনার ভ্যানটা চলার মতো অবস্থায় নেই। যদি উনার একটা ভালো ভ্যান হয় তবে তার কষ্ট কম হবে।
স্থানীয় প্রতিবেশী ফাতেমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন,‘সকালে উঠে হেনে বাড়ির সব কাজকাম শেষ করে। চাইরটা বেটিক গোসল করায় খিলাহেনে ফের ভ্যানে করে বাহির হয়। অনেক কষ্ট করেহেনে সংসারটা চালায়। একটা বেটাও নায় যে কিছু করিবে। নিজের থাকিবারও জায়গা নাই। খালি কষ্ট আর কষ্ট করেচে।’
স্থানীয় ব্যবসায়ী রুহুল পন্ডিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ রকম সংগ্রামী জীবন ঠাকুরগাঁওয়ে আর নেই। চারটা মেয়ের মধ্যে একটা প্রতিবন্ধী। তাদের খরচ, সংসারের খরচ চালানোর জন্য তিনি ভ্যানে করে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। এটি আসলেই প্রশংসার দাবি রাখে। তাকে যদি সরকারি ঘর ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয় তাহলে তিনি পরিবার নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।
নুরজাহান বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২২ বছর আগুত মোর বিহা হয়। স্বামীডা হকারি করে। কষ্ট-মোষ্ট করে সংসারটা চলছিল। চার বছর আগুত মোর টিউমার ধরা পড়ে। সেলা হামার সব শেষ হয় যায়। চারটা বেটি মোর। বড় বেটিডা প্রতিবন্ধী। ছুয়ালাক ঠিকমতো খিলাবা পারুনা। অনেক কষ্ট হয়। আর স্বামীডার হকারির টাকা দিয়াও খরচ জোটে না। সেই তাহানে দুই বছর আগুত ভ্যানত করিয়া ঝালমুড়ি বিক্রি করেচু। যত টাকা হয় সে টাকালা দিয়া ছুয়ালার স্কুলের খরচ দেচু, ফের বাড়ির খরচ করেচু। কি করিম মুই আর। মেলা লোকে খারাপ খারাপ কাথা কহিচে৷ মুই কোনো শুনুনি। মোর কষ্ট মুই ভালো বুঝু। নিজের থাকিবার জাগা নাই। কত কষ্ট করিবা হে মোক মুই আর আল্লাহ জানে ভালো। যদি হামাক সরকারি বাড়ি আর কেহো একখান ভালো ভ্যান দিলেহে, তাহলে ভালো হলেহে।
রহিমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান হান্নু ঢাকা পোস্টকে বলেন, তারা অনেক কষ্ট করে জীবন পরিচালনা করেন। তার বড় মেয়ে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। আর সরকারি ঘরের জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া রয়েছে৷ আশা করা যায় তারা সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাবেন। এ ছাড়াও তাদের ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে৷
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি অবগত হলাম। অনেক কষ্ট করে সংসার পরিচালনা করছেন নুরজাহান বেগম। আসলেই নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা তিনি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।
এম এ সামাদ/আরএআর