জমিদাতা হয়েও উপেক্ষিত ভাষাসৈনিক ডা. আলতাফ
স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা মূল্যের জমি দিয়েও নামকরণে নেই ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলতাফ হোসেনের নাম। বরং স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজ প্রভাবে তার মায়ের নামে স্কুলটির নামকরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন জমিদাতা ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা। তারা প্রকৃত ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে স্কুলের নামকরণের দাবি জানিয়েছেন। শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে যশোর প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ডা. আলতাফ হোসেনের ছেলে মাসুম রেজা বলেন, আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার মুক্তিবার্তা নম্বর- ০৪০৫০২০১২৪, বেসামরিক গেজেট নম্বর-২০৬৮।
১৯৮৫ সালের ১১ অক্টোবর বৃহত্তর খাজুরা বাজারের মাস্টার আব্দুল হামিদ লস্কর, মো. মোমতাজ উদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, হাসান আলীসহ আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে তিনি খাজুরা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটির জন্য আমার বাবা ৩৪ নম্বর মথুরাপুর মৌজার ৯২৮ দাগের ২৬ শতাংশ জমি দান করেন। কিন্তু নিজের নামে নামকরণ না করে বৃহত্তর খাজুরার নামে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন।
বর্তমানে যশোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য রঞ্জিত কুমার রায় নিজ প্রভাবে তার মায়ের নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ করেছেন ‘খাজুরা মাখনবালা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়’। এ বিষয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। নামকরণের পেছনের ব্যক্তিরা অত্যন্ত ক্ষমতাশীল হওয়ায় এলাকাবাসী কোনো প্রতিবাদের সুযোগ পাননি।
সংবাদ সম্মেলনে ডা. আলতাফ হোসেনের ছেলে আরও দাবি করেন, খাজুরা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে টি.পি.এম অর্থাৎ তেলিধান্যপুড়া পান্তাপাড়া, মথুরাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৪ শতাংশ জমি আমার বাবা দান করেছেন। এ ছাড়া টি.পি.এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে খাজুরা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে তিনি ৭ শতাংশ জমি দান করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি দেশের জন্য এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও আমার বাবার ভূমিকা ছিল অনন্য।
মাসুম রেজা বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করায় আমার বাবা, মাস্টার আব্দুল হামিদ লস্করসহ মোট ছয় জন গ্রেপ্তার ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। তখন অ্যাডভোকেট রওশন আলী পুলিশ হেফাজত থেকে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরে আসেন। অ্যাডভোকেট রওশন আলীর মাধ্যমে এ বিষয়ে জানতে পেরে আমার বাবাসহ যে ছয়জন ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গবন্ধু সাইকেলযোগে খাজুরা বাজারে আসেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ভালোবেসে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন আমার বাবা।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে বাঘারপাড়া থানার অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ডা. আলতাফ হোসেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা আন্দোলনেও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন তিনি। ভারতে চাপাবাড়িয়া ক্যাম্পে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দীর্ঘ ৯ মাস নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বাঘারপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং বন্দবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯৯৯) দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে একজন ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুলের জমিদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ডা. আলতাফ হোসেনের নামে নামকরণের দাবি জানানো হয়। এ সময় ডা. আলতাফ হোসেনের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে খাজুরা বাজরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার জমি বর্তমানে ২৫-৩০ লাখ শতাংশ হিসেবে কেনা-বেচা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী স্কুলের জন্য ডা. আলতাফের দান করা জায়গার বর্তমান দাম দাঁড়ায় ন্যূনতম ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা।
তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে নিজের মায়ের নামে স্কুলটির নামকরণের ব্যবস্থা করেন এমপি রঞ্জিত কুমার।
এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান বলেন, জমিদাতা হিসেবে ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলতাফ হোসেনের কোনো তথ্য স্কুলে নেই। রেকর্ডপত্র অনুযায়ী জমিটি খাস খতিয়ানভুক্ত। যার নামে স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে তার স্বজনরা নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এরপর সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের অনুমতি নিয়েই নামকরণ করা হয়েছে।
নামকরণ নিয়ে ওঠা বিতর্কের বিষয়ে জানতে সংসদ সদস্য রঞ্জিত কুমার রায়ের দুটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে স্থানীয় বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবদুল হোসেন খান বলেন, ওই স্কুল এবং শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অবদান রয়েছে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. আলতাফ হোসেনের। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষা বিস্তারসহ এলাকার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। তবে সম্প্রতি তার দেওয়া জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি এমপি সাহেব নিজের মায়ের নামে করে নিয়েছেন।
এমএএস