বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত সেই গ্রাম এখন ‘ইউরোপীয় শহর’
‘আগে যখন গ্রামে ছিলাম তখন বন্যার পানি, জোয়ারের পানি সব সময় ঘরে উঠেছে। চৌকির উপরে উঠে বসে থেকেছি, রান্না করতে পারি নাই। খাইতে পারি নাই। কত কষ্ট করছি, এখন আবাসন পেয়ে আমরা খুব ভালো আছি। শান্তিতে আছি।’ কথাগুলো বলেছিলেন কলাপাড়া উপজেলার চারিপারা গ্রামের ৩নং আবাসনের উপকারভোগী শাহিনা আকতার ছবি।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় শুধু ছবির বাড়ি নয় এলাকাটি এখন ইউরোপীয় শহরে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে এই এলাকায় বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এলাকার মানুষদের জীবন ব্যবস্থাকে উন্নত শহরে ধাবিত করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি অধিগ্রহণ করে জমির মূল্য বাবদ তিন গুণ টাকা দিয়ে তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছাদ ঢালাই দেওয়া একতলা ঘর। যেখানে পানি বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, মসজিদ, বাজারসহ সকল ধরনের সুবিধা রয়েছে।
সাগরে মাছ ধরা জেলে, ক্ষেত খামারে কাজ করা কৃষক, দিনমজুর, নিম্নআয়ের পরিবারগুলো কখনো ভাবেনি বিল্ডিংয়ের ছাদ ঢালাই দেওয়া ঘর হবে তাদের। বন্যার পানি আর জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর এই এলাকার মানুষ আতঙ্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এসেছে। সেখানে দুর্যোগ সহনশীল ঘর পেয়ে অনেক বেশি আনন্দিত তারা।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, পায়রা বন্দরের পুনর্বাসনের প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ ৪৮৪ একর, বন্দরের জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৩০৪৪টি। এই সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মোট ৭টি এলাকায় টাইপ এ এবং টাইপ বি ২ ভাগে ভাগ করে ১৪ টি প্যাকেজের আওতায় পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে প্যাকেজ ১, ২, ৩ ও ৭ এর ২২০০ ঘরের কাজ শেষ হলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে বাকি প্যাকেজের সকল ঘর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
যে সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বাড়ির জমির পরিমাণ ২০ শতকের বেশি ছিল তাদের কে টাইপ এ ক্যাটাগরিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের জন্য নতুন পুর্নবাসন বাড়ির ক্ষেত্রফল ৯৭৮ বর্গ ফুট করা হয়েছে। আর যাদের পূর্বের বাড়ির পরিমাণ ২০ শতকের কম ছিল তাদেরকে টাইপ বি ক্যাটাগরিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। বি টাইপ ঘরের জন্য ৮৮৫ বর্গফুটের ঘর করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে তিনটি বেডরুম, দুটি বাথরুম, একটি রান্নাঘর এবং একটি বারান্দা রয়েছে যার মধ্যে এটাস্ট বাথরুমসহ একটি মাস্টার বেডরুম রয়েছে। এছাড়াও প্রতি ৪টি বাড়ির জন্য একটি সেপটিক ট্যাংক রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে ১০০০ লিটার ধারণক্ষমতার ওভারহেড ওয়াটার ট্যাংক রয়েছে যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
প্রতিটি টাইপ এ এবং টাইপ বি এর পুনর্বাসন এলাকার নাগরিকের জন্য দীর্ঘ জায়গা নিয়ে পুর্নবাসন এলাকার প্রবেশ পথ করা হয়েছে, এছাড়াও স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টার কাম-ক্লিনিক, নান্দনিক মসজিদ, কবরস্থান, বিশুদ্ধ পানি সরবারহের জন্য গভীর নলকূপ ও পাইপলাইন, পুকুর, খেলার মাঠ, মার্কেট, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ড্রেন, সবুজ বনায়নসহ বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন এই সব নাগরিকরা।
উপকারভোগী সালেহা বেগম বলেন, নতুন ঘর দরজা পেয়েছি এখন আমরা খুব ভালো আছি। ভালো পরিবেশে আছি। এখন আর বন্যা কি কইতারি না, আগে যে বন্যার চুবান খাইছি ৫ বছর। জোয়ার আইলে তারতারি করে চৌকিতে উটছি, আবার বেশি পানি আইলে সেন্টারে দৌড়াইছি।
উপকারভোগী ফোরকান প্যাদা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জন্যই আমরা এই ঘরগুলো পেয়েছি। আমাদের যেখানে ঘর দেওয়া হয়েছে সেটা অন্য সব জায়গা থেকে সাত থেকে আট ফুট উঁচু করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনের পরে যাদের বাড়িঘর সরকার নিয়ে যায় তাদেরকে কখনো এমন সুবিধাসহ ঘরবাড়ি দেওয়া হয়নি একমাত্র আমাদেরকেই এত সুন্দর একটি পরিবেশ দিয়েছে।
সাবেক ইউপি সদস্য প্রিন্স বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ সে আমাদেরকে এত সুন্দর একটি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। আমার জানামতে বাইরের দেশেও এরকম কোনো পুর্নবাসন নেই। আমাদের কলাপাড়াতে এই পুর্নবাসন এত সুন্দরভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।
পটুয়াখালী ৪ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মহিবুর রহমান মুহিব বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই এদেশের ১৭ কোটি মানুষের নেত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি অবহেলিত দক্ষিণ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অনেক কাজ করে যাচ্ছেন। পায়রাপোট বাংলাদেশের তৃতীয় সামুদ্রিক সমুদ্র বন্দর আমার নির্বাচনী এলাকায় করা হয়েছে। এই পায়রা পোর্ট করতে গিয়ে যারা জমি দান করেছেন এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর জন্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পূর্ণবাসনের জন্য ঘর করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন প্রায় ৬০০ ঘর এই জুন মাসের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই ঘরগুলো অনেক আধুনিক ও উন্নত মানের। এই ঘরগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের বিনামূল্যে দিচ্ছে। এই ঘরের সঙ্গে স্কুল দিয়েছেন, চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন মসজিদ দিয়েছেন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, এই বন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখনো বেশ কিছু ভূমি অধিগ্রহণ এখনো বাকি রয়েছে। যারা এই বন্দরের ভূমি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ভূমির তিনগুণ দাম বেশি দেওয়া হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি ছিল গাছপালা ছিল তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটা জিনিসের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমরা ঘর উপহার দিচ্ছি। সেই ঘরটাই আমরা আবাসন আকারে দিচ্ছি, ১৪টি প্যাকেজ এ এই ঘরগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০২২ এর ঘর বিতরণ হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি এই ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সবগুলো ঘর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এই ঘরগুলো খুবই সুন্দর ও নান্দনিক দৃষ্টিনন্দন মজবুত করে করা হয়েছে এই আবাসনগুলোতে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবে এই নাগরিকরা। মসজিদ বাজার স্কুলসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
মাহমুদ হাসান রায়হান/আরকে