হতাশায় ডুবে যাওয়া মেহেদীর আয় এখন মাসে দেড় লাখ টাকা
মেহেদী হাসান শুভ পেশায় একজন ফ্রিল্যান্সার। গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন অনলাইনে। কখনো বা অনলাইনে দেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ। এখন গড়ে প্রতি মাসে তার এক লাখ টাকার বেশি। কিন্তু কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন অর্থকষ্টে। হতাশায় ভুগেছেন দীর্ঘদিন। এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন নিজের চেষ্টায়।
তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়নের মাদ্রা গ্রামের আবদুল কাদের সরদারের ছেলে।
২০১৩ সালে কালীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ব্যবসায় শিক্ষা থেকে এসএসসি পাস করেন মেহেদী। পরে ২০১৫ সালে সরকারি মাদারীপুর কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ নিয়ে এইচএসসি পাশ করে একই কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে ২০১৯ সালে বিএ সম্পন্ন করেন। মেহেদীর পরিবারের অবস্থা ছিল অসচ্ছল। বয়স্ক বাবা তেমন কাজ করতে না পারায় সংসারের হাল ধরতে হয় তার।
মেহেদী হাসান শুভ স্নাতক শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নিজেই ‘ড্রিমস আইটি সল্যুশন’ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। শুরুতে এ প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে তার লক্ষ্য ছিল প্রশিক্ষণ দিয়ে আয় করা। কিন্তু শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই দেশে সংক্রমিত হয় করোনা ভাইরাস। কাজ হারিয়ে তিনি তখন বিপাকে পড়েন। তবে দমে যাননি তিনি।
মেহেদী বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ার পর ঘরবন্দী হয়ে চিন্তা করলাম, ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে কাজ করার চেষ্টা করি। তারপরই অনলাইনে ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপর একটি কোর্স করে যাত্রা শুরু করি। দ্রুতই ফাইভার মার্কেটপ্লেসে টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার ব্যাজ অর্জন করি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দুই ভাই ও এক বোন। সবার বড় আমি। পরিবারের পুরো দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধের ওপর। সচ্ছলতা মোটেও ছিল না পরিবারে। ফলে পরিবার ও ছোট ভাই বোনদের পড়াশোনার খরচ আমার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াল। আমি চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে উঠি, কিন্তু ভালো কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। একটা ছোট চাকরি পেলাম। স্বল্প বেতনের অস্থায়ী চাকরি, ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের দেখাশোনা—সব মিলিয়ে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। পরে চাকরি ছেড়ে দেই।
মেহেদী আরও বলেন, ‘আমার ফ্রিলান্সিং শুরু হয় অনলাইনে কাজ পাওয়ার জায়গা ফাইভআর থেকে। অ্যাকাউন্ট খোলার তিন দিনের মাথায় একজন মার্কিন ক্রেতার কাছ থেকে ৩৫ ডলারের একটি কাজ পাই। কাজের মান দেখে ক্রেতা খুশি হয়ে আমাকে পাঁচ তারকা রেটিং দেন। সঙ্গে ১০ ডলার বোনাসও দেন।’
ডিজিটাল মার্কেটিং–সংক্রান্ত কাজ করতে চাইলে একজন ফ্রিল্যান্সারকে প্রথমে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে একটি কোর্স করতে হয়। দক্ষতা অর্জনের পর কোনো ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কাজের জন্য আবেদন করতে হয় বলে জানান মেহেদী।
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ মূলত কী? মেহেদী হাসান বলেন, ‘এটা মূলত অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় কিংবা কোনো সেবা বা প্রতিষ্ঠানের প্রচার-প্রসার করার কাজ। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের মাধ্যমে কোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটকে গুগলে টপ র্যাঙ্কিং করা, ই–মেইল মার্কেটিং, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, সিপিএ মার্কেটিং, ভিডিও মার্কেটিং, কনটেন্ট মার্কেটিংসহ নানা কিছু এ কাজের অন্তর্ভুক্ত। এই কাজ শিখে ফাইভার, আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করে ভিনদেশ থেকে আয় করা যায়।’
বাংলাদেশ সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পের প্রশিক্ষক হিসেবে এরই মধ্যে তিন হাজার মানুষকে অনলাইনে ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন মেহেদী হাসান। এখন তিনি নতুন করে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ৫টি ব্যাচে ২৫০ জন শিক্ষার্থীকে অনলাইনে ক্লাস করান। এখানেও ডিজিটাল মার্কেটিং শেখান তিনি। চারটি ক্লাস করিয়ে প্রতি মাসে মেহেদী হাসান ফিউচার আইটি ইনস্টিটিউট থেকে পান ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
তিনি জানান, নিজের বলার মত একটি গল্প ফাউন্ডেশন নামে আরও একটি ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেখানেও বিনামূল্যে ডিজিটাল মার্কেটিং এ প্রশিক্ষণ দিয়ে বহু তরুণকে ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরি করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। এর আগেও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ‘রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। পরে ফ্রিল্যান্সিং এ প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২৩ সালে গ্লোবাল চেঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি প্রসঙ্গে মেহেদী হাসান শুভ বলেন, ‘এই সম্মান আমার জন্য অনেক গর্বের। দেশের জন্য আগামীতে আরও অনেক স্বীকৃতি আনতে চাই। সেই লক্ষ্য মাথায় রেখে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আরও বেশি মনোযোগী হবো। তরুণ সমাজে বেকারত্ব দূর করে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে তাদের এগিয়ে নিতে আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে।
রাকিব হাসান