তাহারিমার সঙ্গে যুক্ত ২২০০ নারী
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম নির্দেশক পণ্য নকশিকাঁথায় স্বপ্ন বুনে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বত্বাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নারীদের কর্মসংস্থান ‘নূর নকশি মহিলা জাগরণ’। দেশ-বিদেশে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন সম্মাননা। তাহারিমা বেগম। ৩৮ বছর ধরে কাপড়ের ওপর রঙিন সুতার ফোঁড়ে সারা দেশের নকশিকাঁথাশিল্পে সৃষ্টি করেছেন অনন্য উদাহরণ।
ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৈরি তাহারিমা বেগমের নকশিকাঁথার পরিচিতি ও সুনাম সারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নকশিকাঁথার পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবহারের চিন্তা থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বেডশিট, পর্দা ও গৃহসজ্জার উপকরণ তৈরি করছেন তাহারিমা। এতে নিজেকে সফল করার পাশাপাশি তৈরি করছেন আরও অনেক নতুন উদ্যোক্তা।
তাহারিমার নূর নকশি শুধু নকশিকাঁথাশিল্পেই সুমান কুড়াচ্ছে না। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে গৃহবধূ, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, শিক্ষার্থীসহ অসহায়, পিছিয়ে পড়া কয়েক হাজার নারীর।
সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশে নানা সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ইসলামপুর মহল্লার এস এম আবদুল বাকীর সহধর্মিণী তাহারিমা বেগম। সপ্তম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০১৯-এ নারী বিভাগে বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তাহারিমা। পুরস্কার গ্রহণ করেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের হাত থেকে। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশসেরা সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তাহারিমা পান এক লাখ টাকা, ট্রফি ও সনদ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ, নাচোল উপজেলা ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৫টি এজেন্টের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ২০০-এর বেশি বিভিন্ন বয়সী নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে তাহারিমা বেগমের নূর নকশিতে। ঘরে বসেই সংসারের কাজের পাশাপাশি নূর নকশির বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন এসব নারী। তাদের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে জেলা শহরের ইসলামপুরের নূর নকশি বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন ১৫ এজেন্ট। এরপর নূর নকশি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে নকশিকাঁথা।
নূর নকশির নকশিকাঁথা, হোম ডেকর, হ্যান্ডিক্রাফট ও নকশি ব্যাগ, নকশি চাদর, কুশন কভারসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য নিয়ে নূর নকশি পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। এখন ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ করে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করে আসছে তারা।
২০১৮ সালে উড়িষ্যার প্রাদেশিক সরকারের আমন্ত্রণে এমএসএমই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম। তখন থেকেই তাহারিমার নকশিকাঁথা বাণিজ্যিকভাবে ভারতের উড়িষ্যায় রফতানি শুরু হয়। মান বিবেচনায় উন্নত ও অনন্য হওয়ায় সেখানে তাহারিমার নকশিকাঁথার চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
এ বিষয়ে তাহারিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৮২ সালে নিজের তৈরি একটি নকশিকাঁথা ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করতে পেরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পুরোদমে বাণিজ্যিক চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করি। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছি নকশিকাঁথার বিক্রয় কেন্দ্র নূর নকশি। স্বামী ও পরিবারের সবার সহযোগিতায় প্রায় চার দশকের যাত্রা চলমান রয়েছে।
নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয় উল্লেখ করে তাহারিমা বলেন, গ্রামের অসহায়, কর্মহীন নারীদের জন্য কিছু করতে পারাটা সব সময় আমার কাছে গর্বের। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে ঘরে বসে কাপড় আর রঙিন সুতায় ফোঁড় বুনে চলা সব নারীর।
একেকটি নকশিকাঁথা তৈরিতে রকমভেদে সময় লাগে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত। যেগুলোর দাম ৯০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাহারিমা বেগম মহিলা সংস্থা ও ইফাদসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নকশিকাঁথাবিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নকশিকাঁথা তেরি যেহেতু সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি, সেহেতু বর্তমানে নারীরা স্বল্প সময়ে নতুন কিছু তৈরি করতে পারেন, সেই পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন তিনি। প্রায় ১০০ রকমের নকশিকাঁথা রয়েছে নূর নকশি বিক্রয় কেন্দ্রে।
নূর নকশির এজেন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার চরমোহনপুর এলাকার মো. মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার অধীনে প্রায় ৩৫০ জন নারী নকশিকাঁথা তৈরির কাজ করেন। তাদের কাপড় ও সুতা দিয়ে আসি। এরপর তৈরি শেষ হলে নূর নকশিতে বিক্রি করে যান তারা। এজেন্ট হিসেবে প্রত্যেক কাঁথায় আমার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাভ থাকে। এতে বাড়ির মেয়েদের যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে, তেমনি আমিও লাভবান।
রাজমিস্ত্রির স্ত্রী মুক্তারা খাতুন বলেন, সংসারের সব কাজ শেষ করে দুপুরের পর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমন কোনো কাজ থাকে না। সে সময় বসেই পার করতাম। কিন্তু এখন নূর নকশির কাঁথা তেরি করি। মাসে একটা করে কাঁথা তৈরি করে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে ছেলের স্কুলের ফি, খাবারসহ সংসারের বিভিন্ন কাজে লাগাতে পারি।
নবাবগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী রওশন আরা পপি জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাসায় মা, দাদি এসব করেন। করোনায় কলেজ বন্ধ, তাই তাদের সঙ্গে আমিও আট-নয় মাস থেকে নকশিকাঁথা তৈরি করছি। সময়ও কাটছে, কাজও শেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কিছু টাকা উপার্জন করতে পারছি। ভবিষ্যতে আমারও ইচ্ছা নকশিকাঁথার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার।
জেলা পরিষদের সদস্য ও সাবেক উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শান্তনা হক নূর নকশি বিক্রয় কেন্দ্রের একজন নিয়মিত ক্রেতা। তিনি বিক্রয় কেন্দ্রে একটি নকশিকাঁথা নিতে এসেছেন তার আত্মীয়কে উপহার দেওয়ার জন্য। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এখানকার নকশিকাঁথাগুলো খুবই উন্নত মানের এবং খুব সহজেই ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার মতো ডিজাইনের। তাই ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য উপহার হিসেবে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশিকাঁথা দিতে মাঝেমধ্যেই এখানে আসতে হয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিসিকের প্রধান কাজই হলো উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে বিসিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঋণের ব্যবস্থা করাসহ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গর্ব নূর নকশির তাহারিমা বেগম। অনেক সংগ্রামের পর আজ তার এই অবস্থান তৈরি হয়েছে। তার এই সফলতার অংশীদার হতে পেরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিসিক খুবই আনন্দিত ও গর্বিত।
আজাদ হোসেন বলেন, বর্তমানে নূর নকশি সারা দেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। এমনকি এসব পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এসেছে। আমরা চাই তাহারিমা বেগমকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেলার অন্য নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে এগিয়ে আসবেন।
এনএ