খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষুধার কাছে হার মানছে পঞ্চগড়ের তীব্র শীত
‘সকাল আর রাতোত খুব ঠান্ডা বারে, কাজ-কাম করতে কষ্ট হচে। কিন্তু কাজ না করলে খামো কি।’ উত্তরের হাড়কাঁপানো শীতকেও হার মানতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষুধার কাছে। জীবিকার তাগিদ নদীতে যাওয়ার সময় কথাগুলো বলছিলেন পাথর শ্রমিক মো. ইসলামের। এরকম আরিস, জুয়েলসহ অনেকেরই একই কথা।
জীবিকার কাছে হার মানছে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে কঠিন শীত। শীত উপেক্ষা করেই শ্রমিকরা সকালে থেকে কেউ পাথর তুলতে, কেউ চা বাগানে আবার কেউ দিন মজুরি দিতে গেরস্থের বাড়িতে কাজে চলে যায়। দিনভর কুয়াশা ঢাকা শীতের ভেতর কাজ করে দিন শেষে রোজগার নিয়ে বাড়িতে ফিরে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়।
টানা সপ্তাহ ধরেই বইছে এ জেলার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ। শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গতকাল রেকর্ড করা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকা পোস্টকে তাপমাত্রা রেকর্ড হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন জেলার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ।
ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় শীত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এ জেলার শ্রমজীবী-কর্মজীবীসহ অসহায় মানুষ। পাথর শ্রমিক, চা শ্রমিক, দিনমজুর থেকে শুরু করে ছোটখাটো যানবাহন ভ্যানচালক মানুষগুলো পড়েছেন বিপাকে। তবুও জীবিকার তাগিদে কাউকে নদীতে পাথর তুলতে, কাউকে চা-বাগানে আবার কাউকে দিনমজুরের কাজ করতে যেতে দেখা গেছে। শীতের দুর্ভোগ বেড়েছে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে।
স্থানীরা বলছেন, বিকেল হলে হিমেল হাওয়ায় বইতে থাকে কনকনে শীত। সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়তে থাকে শীতের তান্ডব। মধ্যরাত থেকে ভোর অবধি পর্যন্ত বরফের হিমাঞ্চল হয়ে উঠে এ জেলা। দিনের চেয়ে রাতের শীত বেশি মনে হয়। পুরো রাত বরফের মতো লাগে। মনে হয় আমরা বরফের দেশের বাস করছি।
চা শ্রমিক জামাল, জাহেরুল ও নাসির বলেন, বরফের মতো শীত ভাই। চা বাগানে কাজ করতে গেলে হাত-পা অবশ হয়ে আসে। এখন বাগানের পরিচর্যা চলছে। শীতের কারণে গাছের ফ্লাইং, কাটিং করতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবো, কাজ না করলে খামু কী। প্রতিদিনই তো শীত। তাই পরিবারের কথা চিন্তা করে কাজে বের হতে হচ্ছে।
পাথর শ্রমিক ইমরান, আরশেদ আলী ও আবু তাহেরব বলেন, ঠান্ডায় নদীর পানি বরফের মত মনে হয়। তারপরেও আমাদের পাথরই জীবিকা। তাই কাজে বেড়িয়েছি। কদিন ধরে নদীর ঠান্ডা পানিতে কাজ করে জ্বর-সর্দিতে ভুগলাম। ক্ষুধার্ত পেটতো ঠান্ডা বুঝে না। কিন্তু পরিবারের কথা চিন্তা করে সকালেই পাথর তোলার সরঞ্জাম নিয়ে বেড়িয়েছি। একই কথা জানান কয়েকজন দিন মজুর ও নারী পাথর শ্রমিক।
নারী পাথর শ্রমিকরা জানান, তীব্র শীতের কারণে তাদেরও কাজে যেতে কষ্ট হচ্ছে। ঘর সংসার সামলিয়ে তাদেরকে জীবিকার তাগিদে কাজে যেতে হচ্ছে। শীতের কারণে অনেক সময় কাজে যেতে দেরি হলে মহাজনরা কাজে নিতে চান না।
বীজতলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরাও। তারা জানান, ঘন কুয়াশা আর কনকনে শীতের কারণে ক্ষেত-খামারে কাজ করতে পারছেন না। অনেক দেরিতে মাঠে যেতে হচ্ছে। এখন বোরো মৌসুম, ভুট্টা, মরিচ, গমসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করতে হচ্ছে। শীতের কারণে বেলা করে ক্ষেতে গিয়ে কাজ এগুচ্ছে না।
শীতের কারণে পড়ালেখা স্থবির হয়ে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও। স্কুল শিক্ষার্থী তানিয়া, কাজল ও নাইমা খাতুন জানায়, কনকনে শীত। রাতে পড়তে পারি না শীতের কারণে। রাতে যেন তাপমাত্রা জিরোতে চলে আসে। সকালে কুয়াশা আর বাতাসের কারণে প্রাইভেট ও স্কুলে যাওয়াও কষ্ট হচ্ছে।
এদিকে শীতে প্রকোপে বেড়েছে নানান শীতজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু।
চিকিৎসকরা বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে রোগীর চাপ বেড়েছে। এমনিতে শীত মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। শীতজনিত রোগ হিসেবে সর্দি-কাঁশি, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। আর শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তাই এ সময়টাতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে কিছুটা হলেও সুরক্ষা মিলবে।
জেলার প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় গতকালের চেয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টায় ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রেকর্ড করা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। জেলার উপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো.জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে এ পর্যন্ত চল্লিশ হাজার শীত বিতরণ করা হয়েছে। এ জেলার শীতার্ত মানুষের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
এসকে দোয়েল/আরকে