১০ টাকায় রোগী দেখেন ডা. এবাদুল্লাহ
হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। তবে বাড়েনি ডা. মো. এবাদুল্লাহর রোগী দেখার ফি। মাত্র ১০ টাকায় রোগী দেখেন তিনি। প্রতিদিন শতাধিক রোগী দেখেন। তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন অনেকে। অল্প খরচে চিকিৎসাসেবা পেয়ে খুশি রোগী ও স্বজনরা। টানা ৪৩ বছর ধরে এভাবেই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন ‘গরিবের ডাক্তার’ খ্যাত এই চিকিৎসক।
ডা. মো. এবাদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কাঁদাকাটি গ্রামে। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা শহরে বসবাস করেন। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। এরপর জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। সর্বশেষ ২০০৯-২০১০ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর চাকরি থেকে অবসরে চলে যান। অবসর নেওয়ার পরও তিনি তার সেবার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকে সাতক্ষীরা শহরের খান মার্কেটের নওয়াব মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নানা বয়সী রোগীর ভিড়। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবাদুল্লাহর কাছে এসেছেন তারা। দৈনিক এই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন শতাধিক রোগী। বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে আসা রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবনে সুস্থও হয়ে উঠছেন। চিকিৎসকের ফি মাত্র ১০ টাকা।
এদিকে এখানে নেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নামে বাড়তি টাকা আদায়। প্রয়োজনের তাগিদে পরীক্ষার দরকার হলেও সেটার ফি তুলনামূলক অনেক কম। এই চিকিৎকের নওয়াব মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন পদে কাজ করছেন ১০ জন কর্মচারী। তাদের বেতনের ব্যবস্থা হয় এখান থেকেই।
নওয়াব মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ল্যাব ইনচার্জ মাহমুদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুনিয়ায় সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি হলেও আমাদের স্যারের ফি বৃদ্ধি হয়নি। ১০ টাকার বিনিময়ে তিনি অসহায়-দুস্থসহ সর্বসাধারণকে সেবা প্রদান করছেন। বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষাগুলো যে মূল্যে করা হয় আমাদের এখানে তার থেকে অনেক কমে করা হয়।
চিকিৎসকের সহকারী নন্দ দুলাল রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন ১০ টাকার বিনিময়ে কিছুই পাওয়া যায় না। সেখানে ১০ টাকায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া এক প্রকার স্বপ্নের মতো। যে সকল রোগীরা অর্থের অভাবে নামিদামি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারেন না, তারা এই চিকিৎসকের কাছে এসে ১০ টাকায় চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে যান।
চিকিৎসা নিতে আসা আনোয়ারা খাতুন নামে এক রোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ১০ টাকার বিনিময়ে আমরা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি। যারা টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না, তারা এই চিকিৎসকের কাছে আসেন। বাইরে কোথাও চিকিৎসা নিতে গেলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই চিকিৎসকের এখানে কোনো অর্থের প্রয়োজন হয় না। মাত্র ১০ টাকা ফি দিয়ে আগেও চিকিৎসা নিয়েছি, আজকেও এসেছি চিকিৎসা নিতে।
হালিমা বেগম নামের অপর এক রোগী ঢাকা পোস্টকে জানান, ১০ টাকা ফি দিয়ে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়েছেন। আজকে তার ছোট মেয়ের চিকিৎসার জন্য এসেছেন। ১০ টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা পেয়ে তিনি আনন্দিত।
স্বল্পমূল্যে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া ডা. মো. এবাদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলায় চিকিৎসার অভাবে অনেককে মারা যেতে দেখেছি। তাদের চিকিৎসা করানোর সামর্থ ছিল না। মানুষকে ভালোবাসি তাই ফি নিই ১০ টাকা। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মূল্যবৃদ্ধি হলেও আমার চিকিৎসাসেবার মূল্য ১০ টাকাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। অসহায় দুঃস্থ মানুষ আমার কাছে সেবা নিতে আসেন। যারা টাকার অভাবে উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেন না, তারা আমার সেবা নিতে আসেন। যতদিন এই পেশায় রয়েছি মানুষকে এভাবে সেবা দিয়ে যাব।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানবতার কাছে অর্থ কোনো বাধা না, সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ডা. এবাদুল্লাহ। তার পরিবার থেকে তাকে বলা ছিল ন্যূনতম একটা ফি নিয়ে যেন রোগীদের সেবা করেন। দীর্ঘ ৪৩ বছর যাবত উনি সেটাই করে আসছেন। নামেমাত্র ১০ টাকা ফি নিয়ে অসহায় দুস্থ মানুষকে তিনি সেবা দিয়ে আসছেন। ডা. এবাদুল্লাহ আমাদের পরম শ্রদ্ধার ব্যক্তি। বর্তমান যারা চিকিৎসা পেশায় রয়েছেন তাদের সকলের উচিত ডা. এবাদুল্লাহর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। তিনি যেভাবে ফ্রি চিকিৎসা করে যাচ্ছেন, তার মাঝে যে মানবিকতা রয়েছে সেটা অন্য চিকিৎসকদের গ্রহণ করা উচিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাতক্ষীরার সাধারণ সম্পাদক ডা. মনোয়ার হোসেন বলেন, চিকিৎসা জগতে সাতক্ষীরায় যারা আছেন ডা. এবাদুল্লাহ তাদের কাছে একটি শিক্ষা। ডা. এবাদুল্লাহর কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে, জানার আছে, বোঝার আছে। তিনি অত্যন্ত মানবিক একজন মানুষ। ১০ টাকা ফি নিয়ে দীর্ঘ ৪৩ বছর যাবত রোগীদের সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। চিকিৎসাসেবার ইতিহাসে এটি দৃষ্টান্ত।
সোহাগ হোসেন/আরএআর