হোটেল বয় থেকে তিনি আজ ৯ কোম্পানির মালিক
কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলী এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম হাসান টগর। হোটেল বয় হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা টগর আজ দেশ সেরা ব্যবসায়ীদের একজন। এক এক করে গড়েছেন ৯টি কোম্পানি। তার পরিশ্রমে হালিমা টেলিকম লিমিটেড এখন হালিমা গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠিত হালিমা গ্রুপের হালিমা টেলিকম, হালিমা ইলেকট্রনিক্স, হালিমা মোবাইল, হালিমা ওয়ার্ল্ড, এইচ টি ই, নিউ ক্লিক গ্লোবাল, টিপ এক্সেসরিজ, এইচজি এবং হালিমা হোম এপ্লায়েন্স নামে ৯টি কোম্পানি রয়েছে।
তবে সফলতার চূড়ান্তে পৌঁছাতে তাকে পার করতে হয়েছে অনেকটা পথ। ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ’ সবই করেছেন তিনি। নানা চড়াই-উৎরাই পার করে সৎ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি আজ দেশ সেরা হালিমা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে টগরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। তিন ভাই ও এক বোনের মাঝে তিনি মেজো। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লা হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৯৯ সালে কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজ ডিগ্রি পাস করেন আবুল কালাম হাসান টগর।
কুমিল্লা নগরী থেকে সামান্য পূর্ব পাশে আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের চাঁন্দপুর এলাকায় গড়ে তুলেছেন হালিমা হাইটেক পার্ক। সেখান থেকেই হালিমা গ্রুপের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। কুমিল্লা থেকে উৎপাদিত প্রথম কোনো পণ্য যা সারাদেশে মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে তা হলো- হালিমা টেলিকম। এই কোম্পানির মোবাইল চার্জার, হেডফোন, পাওয়ার ব্যাংকসহ অন্যান্য মোবাইল এক্সেসরিজ তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা আবুল কালাম হাসান টগরকে সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতে পোহাতে হয়েছে নানান প্রতিকূলতা। তার সংগ্রামী জীবনের নানা গল্প নিয়ে টগরের কথা হয় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।
কালাম হাসান টগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৯৮ সালের শুরুর দিকে ২১ বছর বয়সে আমাকে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য কুমিল্লা ছেড়ে সিরাজগঞ্জের একটি হোটেলে কাজ শুরু করতে হয়। সেখানে হোটেল বয় হিসেবে কাজ নিয়ে কর্মজীবন শুরু করি। মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নিলেও আমার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী। তাই হোটেল বয় থাকা অবস্থায় সে সময় যখন আমার মাত্র তিন হাজার টাকা পুঁজি হয় আমি ওই টাকা নিয়ে পাড়ি জমাই ঢাকা শহরে। ফার্মগেটসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে গ্রামীনফোনের সিম বিক্রি শুরু করি। ওই তিন হাজার টাকা দিয়ে সে সময়ের গ্রামীণফোন মোবাইল প্রি-পেইড কার্ড কিনে দোকানে দোকানে হেঁটে হেঁটে বিক্রির করে টেলিকম ব্যবসায় পা রাখি। কার্ড বিক্রি করতে গিয়ে গ্রামীনফোন কোম্পানির একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার পরামর্শে গ্রামীনফোনের অথরাইজড সাব ডিলার কুমিল্লাতে নিয়ে আসি ১৯৯৯ সালে। চালু করার প্রথম দিনই গ্রামীনফোন প্রি-পেইড সিমের ওপর প্যাকেজ চালু করে, ওই প্যাকেজটি কুমিল্লা এবং তার আশেপাশে অনেকেই বাড়তি মূল্যে বিক্রি করলেও আমি নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করি। এতে লোকজন আমার প্রতি আস্থা করতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় গ্রামীনফোনের সিম এবং প্রি-পেইড কার্ডের অথরাইজড ডিস্ট্রিবিউটর হই এবং বেশ কয়েকবার পুরো বাংলাদেশে গ্রামীনফোনের বেস্ট ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছি।
গ্রামীনফোনের ডিস্ট্রিবিউটর থাকা অবস্থায় কুমিল্লা এবং এর আশাপাশের অনেক ব্যবসায়ী আমাকে সবসময় বলতেন কিছু মোবাইল এক্সেসরিজ পণ্য এনে তাদের কাছে বিক্রি করতে। তাদের পরামর্শে আমি ঢাকা থেকে মোবাইল এক্সেসরিজ পণ্য এনে এক্সেসরিজ ব্যবসা চালু করি। তখন আমি, আমার ছোট ভাই আর একজন কর্মচারী ছিল। আমি আমার শো-রুম থেকে এক্সেসরিজ পণ্য বিক্রি করতাম। বিক্রি করার একপর্যায়ে চিন্তা করলাম কষ্ট করে কারো এসে পণ্য নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই তাই একটি সাইকেল কিনে নিজেই দোকানে দোকানে গিয়ে পণ্য বিক্রি শুরু করি। তখন চিন্তা আসে অন্যের পণ্য বিক্রি করার চেয়ে নিজের পণ্য বিক্রি করা ভালো।
তাই ২০১০ সালে পাড়ি জমাই সূদূর চীনে এবং শুরু করি নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠান হালিমা টেলিকম। চায়নাতে গিয়ে যখন দেখতে পেলাম আমাদের বাংলাদেশে সবাই নোকিয়া এবং স্যামসাং নামে রেডি পণ্যগুলা এনে বিক্রি করে এবং প্রতিযোগী মনোভাবের কারণে মুনাফা কম হয় তখন আমি চাইনিজদের সঙ্গে কথা বলি। ওরা আমাকে তুমি পারবে না বলে নিরুৎসাহিত করে। যেহেতু আমার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী, তাই আমি চাইনিজদের সঙ্গে মিশে ওদের ফ্যাক্টরিগুলো পরিদর্শন করি তাদের অজান্তে তাদের কাছ থেকে একটু একটু করে শিখি। পরবর্তীতে কিছু সংখ্যক চার্জার এবং ব্যাটারির কাঁচামাল এনে চারটি ছেলেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি চার্জার এবং ব্যাটারি বানানো শুরু করি। প্রথম দিকে আমাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় কারণ ওই সময় দেশে এই টেকনোলজি সম্মন্ধে কারও কোন ধারণা ছিল না। তাই আমাকে অনেক লোকসান গুণতে হয়েছে।
বর্তমানে আমার ফ্যাক্টরি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার পিস মোবাইল চার্জার, ২০ হাজার পিস মোবাইল ব্যাটারি এবং ২ হাজার পিস পাওয়ার ব্যাংক উৎপাদন ও বাজারজাত করি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আমাদের ফ্যাক্টরিতে ৩.৪/২.৪/২ MAH চার্জার এবং 1000 MAH হতে শুরু করে 2600 MAH পর্যন্ত ব্যাটারি ও 10000 MAH পর্যন্ত পাওয়ার ব্যাংক উৎপাদন করেছি।
টগর আরও বলেন, মাত্র ৪ জন দিয়ে শুরু করে বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছে। তাদেরকে আমি নিজেই প্রশিক্ষণ দেই এবং ওদেরকে দক্ষ কর্মী বানাই ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলি। হালিমা টেলিকমের মাধ্যমে কুমিল্লা থেকে ২০১০ সালে বিক্রয় যাত্রা শুরু হয়। হালিমা নামটি আধুনিক না হওয়ায় প্রথম অবস্থায় প্রতিটি জেলাতেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু মায়ের নামে প্রতিষ্ঠান সেহেতু নাম পরিবর্তন না করে নিজের ইচ্ছা এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, থানা এবং উপজেলায় ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ দিয়ে ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মোবাইল এক্সেসরিজ জগতে হালিমা টেলিকমকে এক নম্বর প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। এক নাম্বার প্রতিষ্ঠানে আনতে গিয়ে আমাকে সমগ্র বাংলাদেশটা কমপক্ষে ৫০ বারের বেশি পরিভ্রমণ করতে হয়েছে। এমনও দিন গেছে আমি একদিনে ১০০০ থেকে ১২০০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়েছি। হালিমা গ্রুপের ৯টি প্রতিষ্ঠানে পুরো দেশে ৪শ এর অধিক বিক্রয় কর্মী মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। হালিমা গ্রুপের ৯টি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে সারাদেশে ৩৭৫ জনেরও অধিক ডিলার নিয়োগ আছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই হালিমা গ্রুপের বিভিন্ন পণ্য ইউরোপ, আমেরিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ আমার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যগুলো বিশ্বের সকল দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা। সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
মুন্নী আক্তার নামের এক শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ৭ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি চার্জার সেকশনে। চাকরির শুরুতে আমাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথম মাসেই চার্জার সেকশনের কাজ হাত করে ফেলি। এখন আমি সবকাজ জানি। হালিমা টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হওয়ায় এখানে কাজ করে যে রোজগার হয়, তা দিয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসার চালাতে সহযোগিতা করছি।
ইমন হোসেন নামের এক শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত আড়াই বছর ধরে ব্যাটারি সেকশনে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছি এখানে। রোজগারের টাকা বাবার কাছে নিয়ে দেই, বাবা সংসার চালান। আমি কোনো কাজ না জানা মানুষটা আজ মোবাইলের ব্যাটারি তৈরির সকল কাজ জানি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লা শাখার সাবেক সভাপতি আলমগীর খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, টগর সাহেব যে সংগ্রাম করে জীবনে সফল হয়েছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখার পাশাপাশি হাজারের ওপর শ্রমিকের কর্মসংস্থান, এটা আসলে প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। ইচ্ছে থাকলেই সফল হওয়া যায় টগর সাহেব সেটা প্রমাণ করেছেন। দেশের বেকার যুবকদের তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া উচিৎ।
আরকে