ঢাকার বাজারে বাঁশশিল্পের কদর থাকলেও ভালো নেই শ্রমিকরা
রাস্তার দুপাশে সাজানো রয়েছে বাঁশ। ঝাঁকা, চাঙাড়ি, সাঁঝি, টুকরি (আঞ্চলিক ভাষা) তৈরির জন্য পছন্দের বাঁশগুলো সঠিক পরিমাপে কড়াত দিয়ে কাটা হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার পাড়ে, গাছের ডালে ঝুঁলিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে বাঁশ থেকে তোলা চিকন বেতি। নানা গল্প আর শীতে মিষ্টি রোদে বসে ঝাঁকা, বেতি তোলা আর সাঁজি বুননের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা।
প্রতি শনিবার সাভারের হাটে ঝাঁকা, চাঙাড়ি, সাঁজিসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশের তৈরি করা এসব জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার গুলশান নতুন বাজার, জিঞ্জিরা বাজার, কারওয়ান, আগারগাঁও কৃষি মার্কেট, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ১ নম্বর― এসব এলাকায়ও বিক্রি করা হয় বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আট্টিগ্রাম ইউনিয়নের কুমোতপুর এলাকায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে পরিবারের পুরুষ সদস্যের কাজে সহযোগিত করতে দেখা যায় নারী সদস্যদের। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীরাও বাঁশ-বেতের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কেউ পছন্দের বাঁশ ধারালো দা দিয়ে পরিমাপ করে কেটে টুকরা করছে। এরপর সেই টুকরো বাঁশ থেকে বেতি তুলছে। আবার কেউ বেতি দিয়ে চাঙাড়ি, ঝাঁকা বুনছে। বাঁশ দিয়ে এসব সামগ্রী তৈরি করেই চলে তাদের জীবনসংসার। ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার বাঁশ-বেতশীল্পের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
বাঁশ দিয়ে কি প্রক্রিয়ায় ঝাঁকা তৈরি করা হয়, জানতে চাইলে কুমোতপুর গ্রামের শ্রমিক গুনি চন্দ্র মনিদাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আট্টিগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার হাট থেকে মাকলা বাঁশ কিনে আনি। তবে প্রতিটা বাঁশের দাম আগের চেয়ে বেশি। ভালো মানের একটি বাঁশের দাম পড়ে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা। আর একটি বাঁশ দিয়ে দুই থেকে তিনটি ঝাঁকা বানানো যায়। একেকটি ঝাঁকা বাজারে বিক্রি করা হয় ৮০ থেকে ১৩০ টাকায়।
একই গ্রামের আরেক শ্রমিক আলী চরণ চন্দ্র মনিদাস বলেন, করোনার আগে আমাগো ঝাঁকার ব্যবসা বেশ ভালোই ছিল। বাজারে দরদামও ভালোই পেতাম। তয় দেশে করোনা আইসা আমাগো ব্যবসা নাই বললেই চালে। করোনাকালীন দাম অনেক কমে গেছে আর অন্য কাজকামও শিখি নাই যে সেই কামকাজ কইরা জীবিকা নিবারণ করুম। এ জন্য এই বাঁশের ঝাঁকা বানায়েই চলছি। তয় ঈশ্বর ডাল-ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিবই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শ্রমিক বিদ্যাচন্দ্র মনিদাস বলেন, একদিকে দেশে করোনা হানা দিছে, অন্যদিকে যত্রতত্র প্লাস্টিক জিনিসের উপদ্রবে বাঁশ-বেতের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। অধিকাংশ মানুষই অহন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ব্যবহার করছে। প্লাস্টিকের এসব জিনিসের জন্য আগের মতো মানুষ আর বাঁশের তৈরির জিনিসপত্র ব্যবহার করে না। আমাগো জাতিগত ব্যবসা এইডা। সংসারে তেমন পুঁজি নাই। যে কারণে স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সাপ্তাহিক কিস্তিতে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। ওই টাকা দিয়াই টুকটাক ব্যবসা কইরা বউ-পোলাপানের চাহিদা পূরণসহ সংসারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
৮০ বছরের বৃদ্ধ সুখলাল চন্দ্র মনিদাস বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে এই ঝাঁকা বানানোই শিখেছি। অভাবের তাড়নায় সংসারের ব্যয় খরচ জোগাতে গিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাই নাই। করোনার কারণে হাটবাজারে আমাগো জিনিসগুলার চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। পাইকারি বাজারে বাঁশ-বেতের বানানো জিনিসগুলোর দামেও ভাটা পড়েছে। আর অন্যকিছু করবার পারি না। এহন ঈশ্বরের কৃপা পরিবার নিয়া দিন পার করতাছি। তয় দেশে থাইকা করোনা চইলা গেলে আমাগো ব্যবসাও আগের মতো হইব আশা করছেন তিনি।
প্রমিলা রানী নামের এক গৃহবধূ বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সংসার তো চালাইতে হইব। নিজেরা নয় কষ্ট কইরা চললাম কিন্তু পোলাপানগো তো আর কষ্টে রাখতে পারি না। বিয়ের পর থেকেই সংসারের কাজকাম শেষে স্বামীর বাঁশ-বেতের কাজে কিছুডা জোগান দিয়া আসতাছি। কহনো বাঁশের বেতি তুলা লাগে, রোদে বেতিগুলা শুকানো লাগে আবার কহনো ঝাঁকার চাক বান্দোন লাগে, সাঁজিও বুনাইতে হয়। বাঁশের চাকেই আমাগো জীবনসংসার।
তিনি বলেন, কী করমু। নিজেরা তো লেহাপড়া করবার পারি নাই। তাই পোলা-মাইয়ারে লেহাপড়া করানোর বড্ড ইচ্ছা আছে। এ জন্য কষ্ট অইলেও এই কাজই করি। ঈশ্বর যদি আমগো কোনো একটা হিল্লে করে দেয়, এই আশাই আছি।
একই গ্রামের আরেক গৃহিণী গোপালী রানী বলেন, সংসারের অভাব-অনটনের ঘাটতি পূরণের জন্য তার (স্বামী) লগে সমানতালেই ঝাঁকা বুনি। তাতে তার (স্বামী) অনেক সুবিধা হয়। করোনায় ঝাঁকা বেচাকেনা কম হয় আর দামও কম। পাঁচ বছর আগে চাঙাড়ি বিক্রি করতাম একশত টাকা করে। আর এখন বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। তা ছাড়া আগের চেয়ে বাঁশের দামও বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, স্থানী একটি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়া ব্যবসায় খাটাইছি। অহন মালিকে যা দেয়, তাই দিয়াই সংসার চলতাছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে ঋণের দায় বাড়তে থাকবে। সরকার যদি আমাগোরে বিনা সুদে ঋণ দিত, তাহলে আমাগো অনেক উপকার হইত। সামনের দেশের অবস্থা ভালো হইলে আমাগো জাতিগত (বাঁশ-বেত) ব্যবসাও ভালো হইবার পারে। অহন এই আশাই আছি বলে মন্তব্য করেন এই গৃহিণী।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসরাফিল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার কিছু মানুষ বাঁশ ও বেতশিল্পের ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা দীর্ঘকাল ধরে এটা করে আসছে। একসময় এ সম্প্রদায়ের লোক পশুর চামড়া দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরিন করে জীবিকা নির্বাহ করত। কালের বিবর্তনে এখন আর সেটা করতে না পেরে তারা এখন বাঁশ-বেত দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে। এসব পণ্যের বাজার এদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এখন এই খাতে ধস নেমেছে। তা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এখন যদি তাদের ঋণসহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে তারা সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারবে।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, সহজ শর্তে ঋণের বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়া কুমোতপুর গ্রাম সরেজমিনে পরিদর্শন করা হবে। তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও দেখা হবে।
এ ছাড়া সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা ও জাইকার মাধ্যমে আয়বর্ধনমূলক কাজের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ দেওয়া এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে জানান ইউএনও।
এনএ