মেয়ের কষ্ট দেখে প্রতিবন্ধী স্কুল গড়লেন ভ্যানচালক বাবা
জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী মরিয়ম আক্তার। তার বাবা ভ্যানচালক সেলিম শরীফ। মরিয়মের জন্মের ছয় বছর পর তাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য ঢাকা শহরের অনেক স্কুলে ঘোরেন সেলিম। কিন্তু কোনো স্কুল মরিয়মকে ভর্তি করেনি। কোনো উপায় না পেয়ে পরিবার নিয়ে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় গ্রামে চলে আসেন সেলিম।
মেয়ের করুণ অবস্থা ও তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা সেলিম প্রতিবন্ধীদের জন্য গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে সমাজের প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের পাশাপাশি বয়স্কদের বিনামূল্যে লেখাপড়া ও হস্তশিল্পের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ভ্যানচালক সেলিম শরীফ। তারপর ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ২০২০ সালে বিদ্যালয়ের নামে রাজৈর উপজেলার শাখারপাড়ে ২০ শতাংশ জায়গা কিনে শুরু করেন স্কুলের কাজ। এরপর ২০২১ সালে বিদ্যালয়ের ২২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন সেই স্কুলে স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ১১ জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী। বিদ্যালয়টিতে উপজেলার ২২৫ জন প্রতিবন্ধী লেখাপড়া করছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের নানা ধরনের কাজ শিখিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।
ভ্যানচালক সেলিম শরীফের পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় গ্রামের মোশারফ শরীফের ছেলে সেলিম শরীফ। তিনি পেশায় ভ্যানচালক। তার বড় মেয়ে মরিয়ম জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। মেয়ের জন্মের ছয় বছর পর সেলিম তাকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য অনেক কষ্ট করেন। তারপর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সুপারিশে প্রতিবন্ধী মরিয়মকে শাখারপাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে এখন সে শাখারপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে অনেক কষ্ট পোহাতে হয় সেলিমকে। সেই কষ্ট থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ২০১৭ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়।
২০২০ সালে বিদ্যালয়ের নামে রাজৈর উপজেলার শাখারপাড়ে ২০ শতাংশ জায়গা কিনে শুরু করেন স্কুলের কাজ। সেখানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি হাতের কাজ শেখান শিক্ষকরা। নকশীকাঁথা তৈরি, ঠোঙ্গা তৈরি, মোমবাতি তৈরি, এলইডি বাল্ব তৈরি ও সেলাই প্রশিক্ষণসহ নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বিত্তবানদের সামান্য সহযোগিতায় কোনো রকম চলছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে স্কুলটি প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারবে।
ভ্যানচালক সেলিম শরীফ জানান, তিনি মূলত প্রথমে প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেই সংস্থার মাধ্যমে স্কুল শুরু করেন। তার মেয়ের মতো যারা প্রতিবন্ধী আছে তাদের নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেন। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের এখনো নিজের ভ্যানে করে নিয়ে যান স্কুলে। সকলের সহযোগিতা পেলে প্রতিষ্ঠানটি ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারবে।
প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার বলেন, আমিসহ ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী এখানে কাজ করি। ২০১৮ সাল থেকে বিনা পারিশ্রমিকে স্কুলটিতে কাজ করছি । নিজেদের টাকা ব্যয় করে প্রতিদিন শিক্ষকরা প্রতিবন্ধীদের পাঠদান করাতে আসেন। বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী স্কুলটি বর্তমানে চলছে।
প্রতিবন্ধী মরিয়মের মা আকলিমা আক্তার বলেন, আসলে প্রতিবন্ধী বলতে বোঝা মনে করে অনেকে। আমি মা আমার কাছে বোঝা মনে হয় না। আমারতো তাকে লালন-পালন করতে হয়। প্রতিদিন আমি তাকে হুইল চেয়ারে করে স্কুলে নিয়ে যাই। আবার নিয়ে আছি। আজকে আমার মেয়ের কারণেই আমার স্বামী একটি প্রতিবন্ধী স্কুল তৈরি করতে পেরেছে। এখানে সমাজের সকল অবহেলিত প্রতিবন্ধীরা পড়তে আসে।
প্রতিবন্ধী মরিয়ম বলে, আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমি ভর্তি হতে গেলে কোনো স্কুল আমাকে ভর্তি নেয়নি। আমার বাবা আমার মতো প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন অনেকে এখানে পড়াশোনা করছে। আমরা অনেক খুশি।
আরেক প্রতিবন্ধী শাহরিয়ার করিব বলেন, আমি লেখাপড়া শিখছি এখানে। মোমবাতি বানানো শিখেছি। সরকারের কাছে এই স্কুলের জন্য সাহায্য চাই।
ইশিবপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সাইদুল মোল্লা বলেন, ভ্যানচালক সেলিম যে কাজটি করেছেন সমাজের বিত্তবানরাও তা করতে পারে না। তার উদার এবং মহান কাজের জন্য সমাজের বিত্তবান এবং সরকারের সাহায্য কামনা করি।
রাজৈর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ফজলুল হক ছলাকার, প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সার্বিক উন্নয়নে সমাজসেবা অফিস পাশে থাকবে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, একজন ভ্যানচালক একটি প্রতিবন্ধী স্কুল করেছেন বলে শুনেছি। এটা তার বড় মনের পরিচয়। তিনি এগিয়ে যাবেন। তাকে সহযোগিতা করে সব সময় পাশে থাকব।
রাকিব হাসান/আরএআর