রাতে সাজেকের ভিন্ন রূপ, গান-গল্পে মাতেন পর্যটকরা
সাজেক ভ্যালির নাম শোনেননি এমন ভ্রমণপিপাসু পাওয়া দুষ্কর। বিশাল পর্বতরাশির ওপরে মেঘের রাজ্যকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে ওঠা এই সাজেক ভ্যালি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বছরজুড়েই। সাজেকের কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরবেলায় মেঘের লুকোচুরি আর সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করার ইচ্ছা লালন করেন ভ্রমণপিপাসুরা। তাই সাজেকে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে সাজেকের ভোর সবচেয়ে আরাধ্য।
দিনের সাজেক বা সাজেকে ভোরের আবহ নিয়ে গল্পটা বোধহয় সবারই জানা। কিন্তু এই সাজেকেরই আরেকটি রূপ আছে, যা প্রকাশ পেতে শুরু করে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য মিলিয়ে যাওয়ার পর থেকে। তাই গল্পটা রাতের সাজেকের।
দিনের সাজেকের জীবনযাপনের চিত্রটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর থেকেই। বৈদ্যুতিক বাতির আলো মেখে জেগে উঠতে থাকে পাহাড়ের একটি জনপদ। কটেজগুলোর সামনে বা বারান্দায় জ্বলে উঠে রঙ-বেরঙের বাহারি আলো। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেস্তোরাঁগুলোও সাজে রঙিন আলোতে। কুয়াশা বা মেঘের চাদর ভেদ করে যেন আড়মোড়া ভাঙে দুর্গম পাহাড়ের একটি ছোট্ট শহর।
সাজেকের দিনের বেলার সঙ্গে রাতের বেলার তেমন একটা মিল নেই। বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কাংলক পাহাড়, ত্রিপুরা পল্লী, লুসাই গ্রাম, জিরো পয়েন্ট, হ্যালিপ্যাড আর আশপাশের কিছু জায়গায় ঘুরাঘুরি করে। সন্ধ্যার পরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করে। যেহেতু নিরাপত্তাজনিত কারণে দূরে কোথাও পর্যটকদের যাওয়ার সুযোগ হয় না, তাই বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের সময় কাটে রেস্তোরাঁয় বা এর সামনে বসে আড্ডা, গান, গল্পে।
অনেক রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ লাইভ মিউজিকের ব্যবস্থা রেখেছে। রেস্তোরাঁর নিজস্ব শিল্পীরা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসেন রেস্তোরাঁগুলোর সামনে। গিটারের সুর আর কাহনের তালে পাহাড়ি বা বাংলা গানের সঙ্গে চাইলেই গলা মেলাতে পারবেন। অনেকে আবার হাতে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়েন নিজস্ব গান আড্ডায়। সঙ্গে নিয়ে আসা গিটার, উকুলেলে, জিপসি বাজিয়ে চলে লালনের মিলন হবে কতদিনে কিংবা সোলসের নিসঙ্গতা বা মাইলসের ফিরিয়ে দাও। তাদের ঘিরে জড়ো হন গানপাগল অনেকেই।
সমস্বরে গাওয়া গানগুলোর সুর কুয়াশার চাদরে ভর করে ভেসে যায় পাহাড়ের আনাচে কানাচে। যখন সাজেক ভ্যালি গানে গানে মুখরিত তখন রেস্তোরাঁর কর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করেন বারবিকিউ কিংবা ব্যাম্বো চিকেন, ব্যাম্বো বিরিয়ানি তৈরিতে। প্রায় প্রত্যেকটি রেস্তোরাঁর সামনে বিশাল পরিসরে চলতে থাকে রসনাবিলাসীদের জন্য রাতের এই আয়োজন। রেস্তোরাঁগুলোর সামনে জ্বলতে থাকা আগুন ঘিরেও জমে উঠে দারুণ আড্ডা। সবার হাতে হাতে তখন ব্যাম্বো চা কিংবা তান্দুরি চায়ের কাপ। সাজেক রুইলুইপাড়া যখন গান, আড্ডা-গল্পে মেতে উঠতে শুরু করেছে, তখন অন্য আরেকদিকেও ভিড় বাড়তে শুরু করেছে।
রুইলুইপাড়া পেরিয়ে সাজেক জিরো পয়েন্টের পাশেই হ্যালিপ্যাড ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান। দিনের বেলায় এসব দোকানে তেমন কিছু বিক্রি না হলেও সন্ধ্যার পর থেকে নানা পদের মুখরোচক বিক্রি হয়। চিকেন সাসলিক, কাকড়া, ফিস ফ্রাই, ডালপুরি, বাঁশকোড়ল ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, চিকেন মোমো, অনথন, পাহাড়ি বিনি চালের গুড়ার জিলাপীসহ নানান বাহারি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। নানা রকমের চা-কফিও আছে সাথে। হ্যালিপ্যাডে সূর্যাস্ত উপভোগের পর বেড়াতে আসা পর্যটকরা ভিড় করেন এসব দোকানে। খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে আড্ডা।
দোকানি মো. রফিক বলেন, যারা বেড়াতে আসেন সন্ধ্যার পর থেকে অনেকেই এদিকে ঘুরতে আসেন। আমরাও তাদের জন্য নানা পদের নাস্তা তৈরি করি। সবাই নাস্তা করতে পেরে খুশি হন, আমাদেরও বেচা-বিক্রি মোটামুটি ভালো হয়।
আরেক দোকানদার মো. মনির হোসেন বলেন, আমি প্রায় পাঁচ বছর যাবত এই জায়গায় ফাস্ট ফুডের ব্যবসা করে আসছি। পর্যটন মৌসুমে আমাদের বেচাকেনা ভালো হয়। পর্যটক না থাকলে তখন সমস্যা হয়। আমরা স্থানীয় খাবারের পাশাপাশি সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছের আইটেমগুলো তৈরি করি।
রাতের সাজেক সম্পর্কে বলতে গিয়ে পটুয়াখালী থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক মো. নাইম হোসেন রামিম বলেন, দিনের সাজেকের তুলনায় আমার কাছে রাতের সাজেকটা আরও মুগ্ধকর মনে হয়েছে। আসলে দিনে সকাল বেলা সূর্যোদয় আর বিকেলে সূর্যাস্ত দেখা ছাড়া তেমন কিছুই করার থাকে না। কিন্তু রাতের বেলা সবাই রাস্তায় বের হয়, গান-আড্ডা-খাওয়া দাওয়া হয়, আমার কাছে এই সময়টাই বেশি ভালো মনে হয়েছে।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক নাবিব সুলতান বলেন, রাতের এই আলো ঝলমলে সাজেককে মনে হয় গল্পের বই থেকে উঠে আসা কোনো কল্পনগরী। দিনের সাজেককে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে রাতের সাজেক কতটা প্রাণবন্ত হতে পারে। তবে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে আরও কিছু যোগ করা উচিত। কারণ আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ার পর আর তেমন কিছুই করার থাকে না এখানে।
জুমঘর ইকো রিসোর্টের ব্যবস্থাপক ইয়ারং ত্রিপুরা বলেন, শীতের সময় রাতে সাজেকে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। তাই লোকজন বের হয়ে বাইরে আড্ডা দেয়, কেনাকাটা করে, ঘুরাফেরা করে। আর বিভিন্ন কটেজে গানের আড্ডা বসে, যেগুলো মধ্যরাত পর্যন্ত চলে।
চিম্বাল রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক সুমন চাকমা বলেন, আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট খোলা রাখি। কারণ বাইরে বারবিকিউ পার্টি, গানের আড্ডা হয় অনেক রাত পর্যন্ত। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরা রাতে সাজেকে ভালো সময় কাটান।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাজেকে কমতে থাকে আলোর উপস্থিতি। কোলাহল আর গানের সুর মিলিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।
মিশু মল্লিক/আরএআর