সব দলের সহযোগিতা নিয়ে রংপুরকে এগিয়ে নিতে চাই
রংপুর মহানগরকে একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে দল-মত নির্বিশেষে সবার মতামত ও সহযোগিতা চেয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
তিনি বলেন, রংপুর সব দল ও মতের মানুষের, আমার একার নয়। এ কারণে আমি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সব দলের সহযোগিতা চাই। আমি তাদের আমন্ত্রণ জানাব। আমি মনে করি, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা ও মতামত থাকা প্রয়োজন। সবার সহযোগিতা না থাকলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব হয় না। এজন্য সবার অংশগ্রহণ দেখতে চাই। আমি সবার মতামতের আলোকে রংপুরকে এগিয়ে নিতে চাই।
বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে রংপুর নগরীর কলেজ রোড খামার শান্তিবাগ এলাকায় তার নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
সবার সঙ্গে সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষা প্রসঙ্গে মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আমি স্বৈরাচারী মনোভাব পছন্দ করি না, নিজেও এমনটা নই। বিগত পাঁচ বছরে আমার কাছে প্রত্যেকটা দলের মানুষ সম্মানিত হয়েছে। অন্য দলের, ভিন্ন মতের বা আমার দলের কেউ নয়, এমনকি আমার বিপক্ষে কাজ করেছে এমন কেউই আমার কাছে এসে অসম্মানিত হয়েছে এই রেকর্ড নেই। আমি ধারাবাহিকভাবে সবার সঙ্গে এই সম্পর্কটাকে দৃঢ় করতে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ দিন শেষে এই রংপুরটা আমাদের সবার, তাই সবাই মিলেই আমরা রংপুরকে এগিয়ে নিতে চাইলেই সবকিছু সম্ভব।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, পরপর দুইবারই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবার নেপথ্যে লাঙ্গল প্রতীক ও ব্যক্তি জনপ্রিয়তার মধ্যে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন? জবাবে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা যদি চালু থাকে তাহলে প্রতীকের যে কারিশমা সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রতীক একটা প্রার্থীর মুখ, তবে প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ ভোটারদের কাছে শুধু প্রতীক নয় প্রার্থীও গুরুত্ব বহন করে।
সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে ইভিএম অভিজ্ঞতা-অভিযোগ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আমি নিজেই এবার প্রথম ইভিএমে ভোট দিলাম। এর আগে কখন দেইনি। আর আমাদের মোট ভোটারের মধ্যে অনেক বয়স্ক নারী-পুরুষ রয়েছেন, তাদের ইভিএম সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ইভিএম ক্রুটিপূর্ণ, এটা কখনো স্লো, কখনো হ্যাং হয়ে যায়। এই মেশিনে ভোট পুনরায় গণনার সুযোগ নেই। অনেক বেশি ভোটার উপস্থিত হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইভিএমে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। আমরা দেখেছি সময় শেষেও অনেকগুলো কেন্দ্রে রাত পর্যন্ত ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা শুধু আমাকে ভালোবেসে এই কষ্টটা করেছেন। এটা তো সবার বেলায় নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, ইভিএমে এখনও মানুষের আস্থা তৈরি হয়নি। কারণ এই যন্ত্রটা মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর পেছনে যারা থাকেন, তারা চাইলেই অনেক কিছু করতে পারেন। আমরা দেখেছি ভোট দিতে এসেও অনেক মানুষ ইভিএম স্লো হওয়াতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ফিরে গেছেন। আবার কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে থেকেও ভোট দিতে পারেননি শুধু ফিঙ্গার জটিলতার কারণে। এটাতো অনেক সাধারণ ভোটাররা সহজে নিচ্ছেন না। যদিও ভোটদানের প্রক্রিয়াটা সহজ। আমি মনে করি আগামী ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার আছে। তা নাহলে ভোটবিমুখ ভোটার বাড়বে।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছেন এবং দল-মত নির্বিশেষে সবাই সমর্থন দিয়েছেন বলেই ভোটবিপ্লব হয়েছে দাবি করে মোস্তাফিজার রহমান বলেন, জাতীয় পার্টির মধ্যে একটা সুবিধাভোগী অংশ রয়েছে। এরা দালালের ভূমিকায় থাকে এবং প্রকাশ্যে দালালিও করে। তাদের শুধু দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সাহস নেই। এ কারণে তারা মহাজোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হতে চায়।
তিনি বলেন, রংপুরকে বিক্রি করে জাতীয় পার্টির কিছু নেতা চলছে। আবার রংপুর ছাড়া জাতীয় পার্টিকে আলাদা করে ভাবার সুযোগও নেই। কারণ রংপুরই জাতীয় পার্টির প্রাণ, মূল ঘাটি। যদি বৃহত্তর রংপুরে জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সুবিধাভোগীদের শুধু সাইনবোর্ড নিয়ে থাকতে হবে। কেন্দ্রে যারা গ্রুপিং করছেন, তাদের দিকে মাছিও পড়বে না। তাই আমি মনে করি কারও দালালি না করে নিজের এবং দলের অস্বিত্বটাকে মজবুত করার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
মেয়র সরকারদলীয় প্রার্থীসহ সাতজনের জামানত হারানো এবং নৌকার সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। রংপুরে তাদের দলের একটা বৃহৎ অবস্থান রয়েছে। তাদের সহযোগী অনেক সংগঠনও আছে। যদি আওয়ামী লীগের কর্মী ভোট দিতো তাহলে ৪০ হাজারের বেশি ভোট নৌকায় পড়তো। কিন্তু তাদের কর্মীরাও ভোট দেননি। নৌকার প্রার্থী কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি, এটা তার ব্যর্থতা। আমি মনে করি, তাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, বিদ্বেষের কারণে কেউ কেউ নামমাত্র প্রচারণায় অংশ নিয়ে ফটোসেশন করেছেন। বাস্তবে তারা মনে মনে নৌকার প্রার্থীকে বিশাল ভোটের ব্যবধানে হারাতে চেয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, এখানে এবার বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর কোনো প্রার্থী ছিল না। তাদের কর্মী-সমর্থক ও অনুসারীদের বেশির ভাগ পেয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী। যার কারণে হাতপাখা প্রতীক এবার আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি হতে পেরেছে। বাস্তবে রংপুরে তাদের এতো বেশি ভোট নেই।
বিগত এবং সবশেষ নির্বাচনে জনগণের কাছে তুলে ধরা ইশতেহার বাস্তবায়নে শ্যামাসুন্দরী খালকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র মোস্তাফিজার রহমান বলেন, এবার প্রস্তাবিত ৩১ দফার ইশতেহারে নগরীর সৌন্দর্য রক্ষার্থে শ্যামাসুন্দরী খালকে পুনরুজ্জীবিত করা, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসনসহ ২৫০ বছরের পুরাতন এই শহরকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নগর স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স এবং অঞ্চলভিত্তিক নগর মাতৃসদন কেন্দ্র নির্মাণ করা, খেলাধুলার মাঠ বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা কথা জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, রংপুর সিটি করপোরেশনে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি সরকারদলীয় প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার চেয়ে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৯ ভোট বেশি পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট।
মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে ভোটগ্রহণ শেষে রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে রাত ১২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, লাঙ্গল প্রতীকে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়াল হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট।
তৃতীয় অবস্থানে স্বতন্ত্র প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। ভোট ব্যবধানে চতুর্থ অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ২২ হাজার ৩০৬ ভোট। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নৌকার চেয়ে মোস্তফাজিার রহমান মোস্তফা ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৯ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
এছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেস পার্টির প্রার্থী আবু রায়হান ডাব প্রতীকে ১০ হাজার ৫৪৯ ভোট, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম খোকন গোলাপ ফুল প্রতীকে ৫ হাজার ৮০৯, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) শফিয়ার রহমান মশাল প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ১৫৬ ভোট। খেলাফত মজলিশের তৌহিদুর রহমান মন্ডল রাজু দেওয়াল ঘড়ি প্রতীকে ২ হাজার ৮৬৪ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মেহেদী হাসান বনি হরিণ প্রতীকে ২ হাজার ৬৭৯ ভোট পেয়েছেন।
এমএএস/এমএএস