বিশ্ব রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’
‘আমরা আদিবাসী, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধু না থাকিলে আদিবাসী মরে যেত’ সুরে সুরে গান গাইছিলেন আর কাজ করছিলেন মায়া রানী রবিদাস। তিনি খুব আনন্দিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ধানের চারা রোপণ করে এবং এখন সেই মাঠে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে পারছেন বলে। এদিকে একই দিন শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি পরিদর্শনে এসেছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রতিনিধিরা।
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ‘গিনেস রেকর্ডের’ সকল শর্ত মানা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের প্রতিনিধিরা। মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় ১২০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে দুই জাতের ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। যার ১০০ বিঘায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি।
জানা যায়, বিশ্বে সর্বপ্রথম শস্যচিত্র আঁকা হয় ব্রিটেনে, এরপর জাপানে, তারপর ভারতে। ২০১৯ সালে চীনের ৭৫ বিঘার শস্যচিত্রের রেকর্ড রয়েছে। এবার মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি শস্যচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ১০০ বিঘা জমিতে এবং এটিই একক ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি হবে।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) দুপুরে ওয়ার্ল্ড গিনেস রেকর্ডের পক্ষ থেকে আসা প্রতিনিধিরা মাঠ পরিদর্শন করে তারা শর্ত মানার বিষয়টি জানিয়েছেন। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের মনোনীত প্রতিনিধিরা হলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী।
অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রতিনিধি দলের প্রধান। তিনি বলেন, ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা মোজাইক স্কেচের তৈরি বঙ্গবন্ধুর শতভাগ মিল রয়েছে। স্কেচে ব্যবহার করা হয়েছে দুই ধরনের রং, যা এই শস্যচিত্রের রঙের হুবহু। এটি একটি ক্রপ ফিল্ড মোজাইক। এখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই। শস্যের অবস্থান রয়েছে নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে। প্রতিটি ধানগাছের চারার দূরত্ব ৮ ইঞ্চি, যা রোপণের সঠিক পরিমাপ।’
তিনি আরও বলেন, ‘গিনেস রেকর্ডে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিকৃতি স্থান পেতে হলে অবশ্যই শস্যের ৪০ ভাগ হবে বেজ, আর ৬০ ভাগ হতে হবে মূল ইমেজ। সেটি ঠিক আছে কি না, তার সঠিক তথ্য দেবেন সার্ভেয়ার। এই শস্যচিত্র দেখে আমরা শতভাগ সন্তুষ্ট হয়েছি। আজকের প্রতিবেদন আমরা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের প্রধান কার্যালয় ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেব। আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্য সিদ্ধান্ত আসবে।’
পরিদর্শন আসা আরেক প্রতিনিধি অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড প্রধান কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ওই অঞ্চল (বগুড়ার শেরপুরে) পরিদর্শন করে ক্রপ মোজাইকের উপর কী পরিমাণ কাজ করা হয়েছে। কোন ধরনের শস্য ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিষয়গুলো দেখে সঠিক প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠাতে। মাঠ পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বৃহত্তর আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সার্ভে করে দেখা গেছে এটার আয়তন দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার ও প্রস্থ ৩০০ মিটার। মূল অবয়বের বাইরে আরও জায়গা রয়েছে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সব শর্ত ও নির্দেশনা শতভাগ মানা হয়। এটির ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার মতো অবস্থা রয়েছে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মু. আব্দুর রাজ্জাক, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু, সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একেএম আসাদুর রহমান দুলু, ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
প্রকল্প এলাকা পরির্দশন করে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’ আহ্বায়ক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু; মুজিব শতবর্ষ উদযাপনের এটি একটি ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। এটি বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা হবে। বিশ্বকে জানাতে চাই বাংলাদেশ জাগ্রত হয়েছে। নান্দনিক ছবির মাধ্যমে জাতির জনকের প্রতিকৃতি তুলে ধরা হবে বিশ্বে। যা স্থান পাবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।’
শস্যচিত্রের এই প্রকল্প জরিপ করছে শেরপুর উপজেলা প্রশাসন। এই দলের দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন, উপজেলা সার্ভেয়ার হাবিবুল ইসলাম বাবলু, সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় ৬ জনের একটি দল পরিমাপ করছেন। জমি জরিপের ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে পরিমাপ করা হচ্ছে। সঠিক তথ্য পেতে আরও তিন থেকে চারদিন সময় লাগবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গঠিত জাতীয় পরিষদের উদ্যোগে এবং ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার নামে একটি কোম্পানির অর্থায়নে প্রতিকৃতিটি তৈরি করা হয়। ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের’ সদস্য সচিব কৃষিবিদ কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান হলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
কেএসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন লড়াই করেছেন মানুষের অধিকার ও কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায়। তাই দুই রঙের ধান গাছই বেছে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকার জন্যে। গিনেস বুকে স্থান দেওয়ার জন্য গত বছরের মার্চ মাস থেকে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ কর্মসূচির কাজ শুরু করা হয়। বেগুনি ও সবুজ রঙের ধানগাছে ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।’
আয়োজকরা জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ জন নারী শ্রমিক কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদিন যুক্ত ছিলেন ১৫ থেকে ২০ জন পুরুষ শ্রমিক।
তারা আরও জানান, এর আগে ১৩ রেজিমেন্টের বিএনসিসির ১০০ জন করে সদস্য প্রতিকৃতি তৈরি করা করেছেন। একদল শুকনো জমিতে প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে। আরেকদল কাদা জমিতে লে-আউট তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে বগুড়ার আজিজুল হক সরকারি কলেজ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, সরকারি শাহ সুলতানসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করেন।
পরে নকশার দায়িত্ব পায় এক্সপ্রেশন লিমিটেড নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান। এই ১০০ বিঘা জমি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি বিঘা জমি ৯ হাজার টাকায় সাত মাসের (নভেম্বর থেকে মে) জন্য ইজারা নেওয়া হয়। এই ফসল উঠে গেলে কৃষকদের আবার তাদের জমি ফেরত দেওয়া হবে।
প্রকল্পটির ব্যবস্থাপক ও ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’ একটা ইউনিক প্রজেক্ট। মূল উদ্দেশ্য হলো শস্যচিত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা। পাশাপাশি এই শস্যচিত্র গিনেস বুকে অন্তর্ভুক্তি করার প্রচেষ্টা। গিনেস কর্তৃপক্ষের সব শর্ত মেনেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
সাখাওয়াত হোসেন জনি/এমএসআর