লক্ষ্মীপুরে হাতে ভাজা গিগজ মুড়িতে ৮ কোটি টাকা লেনদেন
সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুরে নারিকেল-সুপারি ও ইলিশের সঙ্গে ঐহিত্যবাহী খাবারে মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি হচ্ছে গিগজ ধানের হাতে ভাজা মুড়ি। শুধুমাত্র লবণ পানি দিয়েই এ মুড়ি ভাজা হয়। এতে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না। মুড়িগুলো খেতেও সুস্বাদু। মেঘনার তাজার ইলিশ ভাজা আর গিগজ মুড়ির স্বাদ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন ছুটে আসেন লক্ষ্মীপুরে।
এ জেলায় প্রতি বছর প্রায় ৫০০ টন হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি উৎপাদিত হয়। লক্ষ্মীপুরের চাহিদা মিটিয়ে এ মুড়ি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও এ মুড়ি রপ্তানি হয় বলে জানা গেছে। আর এ শিল্পকে ঘিরেই লক্ষ্মীপুরে বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকা লেনদেন হয় বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বেশি দামে গিগজ ধান ক্রয়সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে দিন দিন মুড়ি শিল্পটি হুমকি মুখে পড়ছে। আর্থিক সংকটে কমে যাচ্ছে উদ্যোক্তা।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকেই হাতে ভাজা গিগজ ধানের চালের মুড়ি স্বাদ ও প্রাকৃতিকতার জন্য সারাদেশে বিখ্যাত। তবে গত কয়েক বছর ধরে ধানের বিলুপ্তি ও মেশিনে ভাজা মুড়ির আধিপত্যের কারণে হাতে ভাজার ঐতিহ্যটি হারাতে বসেছে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুড়ি উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে। শ্রম অনুযায়ী মুড়িতে এখন লাভ নেই বললেই চলে। এতে দিন দিন উদ্যোক্তা কমে যাচ্ছে। আর ভাটা পড়ছে শিল্পটিতে। এক সময় ১ হাজার টনেরও বেশি মুড়ি এ জেলায় উৎপাদন হতো। বর্তমানে প্রায় ৫০০ টন মুড়ি উৎপাদন হয় জেলায়। প্রতিকেজি মুড়ি ১২০-১৩০ টাকা বিক্রি করেন উদ্যোক্তারা। আর ব্যবসায়ীরা ১৬০ টাকা কেজি দরে মুড়ি বিক্রি করছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগরসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরেই রাখতেই তারা এখনও মুড়ি উৎপাদন করে জীবিকা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা বিশ্ববাজারেও পৌঁছে দিচ্ছে সুস্বাদু এ মুড়ি। এখানকার উৎপাদিত এ মুড়ি দেশ-বিদেশে ব্র্যান্ড হিসেবেও পরিচিত বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে, এ জেলায় এক সময় গিগজ ধানের চাষাবাদ বেশি ছিল। বর্তমানে গিগজ ধানের উৎপাদন প্রায় বিলুপ্ত। জেলার মজুচৌধুরীর হাট, চরবংশী মোল্লারহাট, তোরাবগঞ্জ বাজার, উত্তর মার্টিন বাজার, মতিরহাট, করুনানগর ও রামগতি বাজার ও আড়তে গিগজ ধান ক্রয় বিক্রয় হয়। গিগজ ধানের পাশাপাশি একই মানের ভূষিহারা, ধলামোডা জাতের দেশীয় ধান থেকেও এ মুড়ি তৈরি হয়।
মুড়ি উৎপাদনের এলাকাগুলো হলো, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সমসেরাবাদ, উত্তর মজুপুর, বেঁড়িরমাথা, কমলনগর উপজেলার করুনানগর, দক্ষিণ গ্রাম, উত্তর গ্রাম, চর জাঙালিয়া, রামগতি উপজেলার চর ডাক্তার এবং রঘুনাথপুর হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির জন্য বিখ্যাত। এ ৮টি গ্রামের শতাধিক পরিবারের হাজার মানুষের প্রধান জীবিকা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি।
লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সমসেরাবাদ এলাকার জোড় দিঘীরপাড় এলাকায় প্রায় ৩০টি পরিবার হাতে ভেজে মুড়ি উৎপাদন করেন। সম্প্রতি সেখানে কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, ধান ক্রয়ের পর শুকানো থেকে শুরু করে চাল সংগ্রহও তাদের করতে হয়। প্রতিদিন ভোর রাত টা থেকে তারা মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে তারা মুড়ি ভাজেন। আশপাশের নারী শ্রমিকরা এ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এ মুড়ি ভাজতে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না। শুধুমাত্র লবণ পানি দিয়ে চাল ভিজিয়ে মুড়িগুলো ভাজা হয়। প্রতিদিন মুড়ি ভাজতে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের।
একই এলাকার সরকার বাড়ির মুড়ি শিল্পের কারিগর ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন হলেন বাবুল দাস। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মুড়ি ও খই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। শহরের ওপর জমি কিনে তিনি বহুতল বাড়িও করেছেন। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সুযোগ থাকলেও তিনি পূর্ব-পুরুষের পেশা ছাড়েননি। তার কাছে হাতে ভাজা মুড়ি ঐত্যিবাহী খাবার। তাদের বাড়ির সকল পরিবারই মুড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বাবুল দাস জানান, অত্যন্ত কষ্টকর হলেও বংশগতভাবেই তিনি এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এক সময় হাতে ভাজা মুড়ির দখলে ছিল স্থানীয় হাটগুলো। এখন মেশিনে ভাজা মুড়ি সয়লাব হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে কষ্ট হিসেবে সঠিক মূল্য পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে ঋণ কিংবা অন্য কোনোভাবে তাদেরকে কোনো সহায়তা করা হচ্ছে না। দিন দিন ধানের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পেশার সঙ্গে জড়িত থাকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সদর মডেল থানা রোডের ৩ জন ব্যবসায়ী জানান, মেশিনে ভাজা গিগজ মুড়ি ও অটো মুড়ি বাজারে সয়লাব হয়ে পড়েছে। দাম কম হওয়ায় অটো মুড়ি বেশি বেচাকেনা হচ্ছে। এতে হাতেভাজা গিগজ মুড়ির বিক্রি কমে যাচ্ছে। তবে স্থানীয়দের মাঝে এখনও হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির চাহিদা বেশি। হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি খান, তারা অন্য মুড়ি মুখেই তোলেন না। দাম বেশি হলেও হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি দোকানে রাখতেই হয়। মাঝে মাঝে কয়েকজন ঢাকার রপ্তানিকারক মালেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকাতে লক্ষ্মীপুরের মুড়ি রপ্তানি করেন। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়ার সময় ৫-১০ কেজি গিগজ মুড়ি সঙ্গে নিয়ে যান বলেও জানান তারা।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা রাকিব উদ্দিন বলেন, মুড়ি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রকল্প। আমাদের অধীনেও মুড়ি উৎপাদন কারখানা রয়েছে। কিন্তু গ্রামীণভাবে হাতে ভাজা মুড়ি উদ্যোক্তাদের বিষয়ে আমাদের জানা ছিল না। তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সরকারিভাবে তাদেরকে স্বল্পসুদে ঋণসহ বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
এমএএস