পাকা বাড়ি থাকার পরও পেয়েছে আশ্রয়ণের ঘর, বেশিরভাগেই ঝুলছে তালা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাকা ঘরে রয়েছে বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন সুবিধা। তবুও আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব ঘরে থাকছেন না বেশিরভাগ সুবিধাভোগী। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর ১৪টি ঘরের মধ্যে ৮টিতেই ঝুলছে তালা।
উপহারের ঘরে থাকা সুবিধাভোগী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, এখানকার রঙিন টিনের পাকা বাড়িগুলো গৃহস্থ বাড়ির মতো। এমন সুন্দর বাড়ি পেয়েও বসবাস করছেন না অনেকে। ঘরের সামনে স্থান পেয়েছে গরু-ছাগল। স্থানীয়দের অভিযোগ, অসহায় ভূমিহীনদের ঘর না দিয়ে বিত্তবানদের বাড়িগুলো দেওয়া হয়েছে। তাই তারা নিজ বাড়ি রেখে উপহারের ঘরে বসবাস করছেন না।
সরেজমিনে রতনপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১৪টি ঘরের জন্য দেওয়া রয়েছে পানির পাম্প, বিদ্যুৎ সংযোগ। অথচ বসবাসযোগ্য এসব বাড়িতে বসবাস করছেন না সুবিধাভোগীরা। ৮টি ঘরে থাকছেন না কোনো সুবিধাভোগী।
এদিকে রাস্তার পাশের তিনটি বাড়ির মধ্যে একটি বাড়ি পেয়েছেন গোমস্তাপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বাসভবনের কেয়ারটেকার মোশাররফ হোসেন মুসা। তবে রহনপুর পৌর এলাকার কাশিমপুরে তার নিজস্ব বাড়ি থাকায় উপহারের ঘরে বসবাস করছেন না তিনি। তার স্ত্রী শিউলি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে শ্বশুর বাড়িতে জায়গা পেয়েছি। তাই পাকা বাড়ি করেছি। পরিবার নিয়ে আমরা এখানেই থাকি। মাঝে মধ্যে আমার স্বামী উপহারের ঘরে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য থাকে।
বসবাস না করলে উপহারের ঘর নিয়েছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শিউলি বেগম আরও বলেন, পরিবারে ছেলেমেয়ে আছে, তারা এখন ছোট। বড় হলে ছেলেমেয়েকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেব।
রতনপুরে উপহারের ঘর পেয়েও বসবাস করছেন না আরও ৫ জন। সুবিধাভোগীরা হলেন- ওমর আলী, মোজাফফর হোসেন, শুভঙ্কর, বাবু আলী ও মনিরুল ইসলাম।
উপহারের ঘর পেয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন মেরিনা বেগম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমাদের থাকার ঘর ও জমিজমা কিছুই ছিল না। পরে সরকারের দেওয়া উপহারের এই ঘরে বসবাস করছি। ঘরটি পেয়ে খুবই উপকার হয়েছে। সরকার ঘর দেওয়ার পাশাপাশি বিদুৎ, পানির ব্যবস্থা করেছে। এখানে সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পাশের ঘরটি পেয়েছে মনিরুল ইসলাম। কিন্তু তিনি এখানে এসে থাকেন না। দুই তিনমাস পরে একদিন সকালে আসে বিকেলে চলে যায়। শুধু মনিরুল ইসলামই নয়, এখানে আরও ৫টি বাড়িতে এভাবেই কেউ বসবাস করছে না৷ তবে কেন থাকছে না, তা বলতে পারব না।
রতনপুর জামে মসজিদের ইমাম মেরাজ আহম্মেদ জানান, ভূমিহীনদের মাঝে ঘর উপহার দেওয়া সরকারের খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে তা বিভিন্ন কারণে সফল হচ্ছে না। এই বাড়িগুলো সরকার করে দেওয়ার পরে কেউ আসেনি। সব সময় বন্ধই থাকে। তবে মাঝে মাঝে দেখি সন্ধ্যার পরে কিছুলোক এসে ঘরগুলো খুলে আড্ডা দেয়, ধুমপান করে। আবার তালা দিয়ে চলে যায়। এসব ঘর হয়ত গরিব অসহায়দের পরিবর্তে বিত্তবানরা পেয়ে গেছে। তাই তারা বসবাস করে না। ঘরগুলো ফিরিয়ে নিয়ে স্থানীয় গরিব, অসহায়, ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করলে ভালো হবে।
উপহারের ঘরের সামনে আবু বক্করের দোকান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘরগুলো দেওয়ার যাদের দেওয়া হয়েছে মাঝে মাঝে তারা আসত। কিন্তু গত এক বছর থেকে আর কেউ আসে না। এই উপহারের ঘরের থেকে ভালো বাড়ি তাদের আছে বলেই এখানে থাকে না। স্থানীয়রা এই ঘরগুলোর সামনে গরু বেঁধে রাখে। এতে সরকারের অপচয় হচ্ছে।
নজিবুর রহমান নামে এক স্থনীয় বাসিন্দা বলেন, এই উপহারের ঘরের মাটিতে আমার বাড়ি ছিল। আমাকে উঠিয়ে দিয়ে গুচ্ছগ্রাম করা হয়েছে। কিন্তু লাভ কী হয়েছে? তারা তো ঘর পেয়েও থাকছে না। আমার থাকার জায়গা নেই। আমাকে একটা ঘর দিলে তো বসবাস করতে পারতাম। এমনকি আমাকে ঘর দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পাইনি।
শাকির রাহমান নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, এই ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবুও দেখছি গত ৬ মাস থেকেই তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে, কেউ বসবাস করছে না। হয়ত যাদেরকে বাড়িগুলো দেওয়া হয়েছে, তাদের উপহারের ঘরের থেকে ভালো বাড়ি রয়েছে। তাই তারা বসবাস করছে না।
রহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান সোহরাব মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপহারের ঘরে না থাকার বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর রাখছি। যারা থাকছে না, তাদেরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ঘরে ফিরেছে, কিছু লোক এখনও বাইরে আছে। তাদেরকেও উপহারের ঘরে ফেরাতে কাজ চলছে।
গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা খাতুন জানান, বর্তমানে গোমস্তাপুর উপজেলায় ৬৫৮টি পরিবার উপহারের ঘরে বসবাস করছে। তাদের অনেকেই পেশাগত কারণে বসবাস করছে না। ইতোমধ্যে ১০ জনের ঘর বাতিল করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পেশাগত কারণে অনেকেই উপহার ঘর রেখে ঢাকা বা রাজশাহীতে অবস্থান করছেন। ভূমিহীন হওয়ায় মানবিক কারণে তাদেরকে উপহারের ঘর প্রদান করা হয়েছে বা বাতিল করা হয়নি। কিন্তু বিত্তবান বা পৃথক জমি ও বাসস্থান রয়েছে এমন কেউ উপহারের ঘর পেয়ে থাকলে তা বাতিল করা হবে।
জাহাঙ্গীর আলম/আরকে