মাস্টার্স শেষে গড়ে তুলেছেন কুমড়াবড়ির কারখানা, কাজ করছেন ৪৫ জন
ওয়াহিদ হাসান। বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জে। ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। এরপর চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে গড়ে তুলেছেন কুমড়াবড়ি তৈরির কারখানা। তার কারখানায় কাজ করছেন ৫৫ জন দুঃস্থ নারী-পুরুষ। মাষকলাই ও চালকুমড়া দিয়ে উৎপাদিত সুস্বাদু বড়ি পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
সরেজমিনে দেখা যায়, খোলা আকাশের নিচে সারি সারি কুমড়াবড়ি রোদে শুকানো হচ্ছে। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে নারীরা মেশিনে কুমড়া ও ডাল দিয়ে পেস্ট তৈরি করছেন। অন্য নারীরা সেগুলো নেটের ওপর ছোট ছোট করে বড়ি বানাচ্ছেন। পুরুষরা সেগুলো নিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। আবার শুকানো বড়িগুলো নেট থেকে ছাড়িয়ে মাটিতে শুকাতে দেওয়া হচ্ছে। এই কর্মযজ্ঞ চলে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।
এরই মধ্যে দেখা মেলে উদ্যোক্তা ওয়াহিদের। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি এই কারখানার মালিক। নারী- পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করছেন। প্রায় ৬ বছর ধরে শীত মৌসুমে ৫-৬ মাস ধরে বড়ি তৈরির কাজ করছেন। প্রতিদিন ১০ মণ বড়ি তৈরিতে খরচ হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। যা থেকে দৈনিক ৪-৫ হাজার টাকা লাভ হয়।
উদ্যোক্তা ওয়াহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করি। পড়াশুনা শেষ করার পর চাকরি না করে ব্যবসা শুরু করি। ছোট থেকেই চিন্তা-ভাবনা ছিল নিজে ব্যবসা করব।
তিনি বলেন, শুরুর দিকে ১৫-২০ কেজি ডালের বড়ি বানানো হতো। বর্তমানে ৪০০ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করা হয়। কারখানায় ৪০ জন নারী নিয়মিত কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এছাড়া চারজন পুরুষ ১২-১৩ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নিয়মিত কাজ করেন। এখানে ৪০-৪৫ জন পুরুষ-নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এছাড়া বড়ি বিক্রির কাজ করেন ১০-১৫ জন। বড়ি তৈরির পর তা রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, কারখানায় প্রতিদিন ৪০০ কেজি বড়ি উৎপাদনে উপকরণ বাদে ৭-৮ হাজার টাকা খরচ হয়। সব খরচ মিলে প্রতি কেজি বড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ১৪০ টাকা। পাইকারি বিক্রয় করা হয় ১৫০ টাকা দরে। মাত্র ১০ টাকা লাভে বিক্রয় করা হয়, যার ফলে মার্কেটে বিক্রিও হয় বেশি।
ওয়াহিদ বলেন, আগে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এই ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করতে ১০-১৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। যদি সরকারিভাবে অল্প সুদে ঋণ পাওয়া যেত তাহলে কারখানার পরিধি আরও বাড়াব। এতে আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
শ্রমিক মজনু হোসেন ও জসিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫-৬ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছি। এখানে নারীরা যে বড়িগুলো তৈরি করেন, সেগুলোকে রোদে শুকাতে হয়। বড়িগুলো রোদে শুকানোর পর সেগুলোকে নেট থেকে তুলে প্যাকেট করে কার্টনে রাখতে হয়। এভাবে এক টানা ৪-৫ মাস কাজ করি। শীত মৌসুম চলে গেলে আবার মাঠের কাজ করি আমরা।
কারখানার নারী শ্রমিকরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে বাড়ির কাজ শেষ করে কারখানায় আসি। প্রথমে মেশিনে ডালের পেস্ট করি। এরপর সেগুলোকে জালের ওপর বসানো হয়। এভাবে শীত মৌসুম ধরেই একটানা দুই থেকে তিন ঘণ্টা কাজ হয়। এই কাজ করে প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ টাকা পায়। এই টাকা দিয়ে সংসারের খরচ মেটানো হয়।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজগর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষিপণ্য উৎপাদন করে চাষি ভাইরা সঠিক দাম পান না বলে সব সময় অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু এই কৃষিপণ্যকে যদি এগ্রোবেজ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সেই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার কৃষকরাও তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম পাই। এমনি এক ধরনের প্রকল্প নিয়ে ৬ বছর ধরে কাজ করছেন ওয়াহিদ হাসান। প্রথমে তার বাবা বড়ি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। আস্তে আস্তে বেশি পরিমাণ তৈরি করে ঢাকায় বিক্রি শুরু করে। ব্যবসায় লাভ ভালো হওয়ায় সেখান থেকেই দেখে তিনিও এই কাজে মনোনিবেশ করেন।
তিনি আরও বলেন, ওয়াহিদ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার বাজার থেকে মাষকলাই কিনে এবং বিভিন্ন বাজার থেকে চালকুমড়া সংগ্রহ করেন। বাজার থেকে এক কেজি ডাল বা একটি চালকুমড়ার দাম পড়ছে ৫০ টাকা। আবার এগুলো দিয়ে যখন বড়ি তৈরি হচ্ছে তখন তার দাম হচ্ছে ১৫০-৩০০ টাকা। এভাবে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
তিনি বলেন, শিক্ষিত এই যুবক নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। ওয়াহিদের এমন কাজে আরও অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এতে বাণিজ্যিকভাবে কুমড়াবড়ি তৈরি বাড়ছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/এসপি