‘রংপুর হামার রঙে ভরা রে, আরে ও বন্ধু আইসেন হামার বাড়ি’
তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী, আলাইকুড়ি, মানাস, ধুম, চিকলি, বুল্লাই, নলেয়া, বুড়াইল, ইছামতি, শ্যামাসুন্দরী, আখিরাসহ অন্তত ২৮ নদ-নদী বিধৌত উত্তরের প্রাচীনতম জেলা রংপুর। ‘বাহের দ্যাশ’ খ্যাত এ জেলাকে বলা হয় রঙে রসে ভরপুর ভূমি। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের উর্বরভূমিও রংপুর। উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম এই জনপদের রয়েছে গৌবরোজ্জ্বল ইতিহাস। ভ্রমণপিপাসুদের ভাওয়াইয়ার সুর সমৃদ্ধ এ জেলায় গানে গানে স্বাগত জানানো হয়।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন থেকে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন এর সবই শুরু হয়েছিলো এখান থেকেই। রয়েছে প্রাচীতম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’ প্রকাশনার গৌরব। পৃথিবীর ইতিহাসে তীর-ধনুক, লাঠিসোটা হাতে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার কৃতিত্বটাও এই অঞ্চলের মানুষের।
কৃষক-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নূরলদীনের এই রংপুরেই জন্ম নিয়েছে নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রয়েছে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিজড়িত টাউন হল। মুছে যায়নি প্রাচীন পুরাকীর্তি আর পুরোনো গল্প। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে এখানকার জীবনচিত্র। এসেছে নানান পরিবর্তন। রূপের মেলায় নিত্যনতুন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রঙে রসে আরও রঙিন হয়ে উঠেছে এই জেলা।
সব বয়সী মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য উত্তরবঙ্গের অন্য কোনো জেলায় রংপুরের মতো এতো বেশি বিনোদন স্পট নেই। তাই সুযোগ পেলে সময় নিয়ে আসতে পারেন বাহের দেশ খ্যাত রংপুরে। বিনোদনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন আপনার জানা-অজানা ইতিহাসও। হয়তো পাঠ্যবইয়ে পড়েছেন, কিন্তু দেখা হয়নি চোখ মেলে। তাইতো এ অঞ্চলের মানুষরাও ভাওয়াইয়ার সুরে আমন্ত্রণ জানান। ‘রংপুর হামার রঙে ভরা রে, আরে ও বন্ধু আইসেন হামার বাড়ি’।
রংপুর মহানগরী থেকে একটু দূরে হওয়ায় নেই ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো যানজট। নেই ধোঁয়া, ধুলো, হইহুল্লোড় বা শব্দ দূষণ। ব্যস্ত নগরী থেকে যতো দূরে ছুটবে ততোই মুগ্ধ হবেন সবুজের মায়ায়। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে গরুর গাড়ি আর সুবজ ক্ষেতে কৃষাণ কৃষানীর ভাওয়াইয়া সুর। শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে পাখির মিষ্টি কলতান।
রংপুর শহর ছাড়লেই মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ। যেখানে রয়েছে নারী জাগরণের অগ্রজ বেগম রোকেয়ার বসতভিটার স্মৃতিচিহ্ন। এখান থেকেই এই মহীয়সী নারী ছড়িয়েছেন মুক্তির আলো। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন দুইশ বছরের প্রাচীন নির্দশন মিঠাপুকুর লাল মসজিদ দেখতে। চারপাশের সবুজ শ্যামল ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি।
ঘুরে দেখতে পারেন পুরাতন রংপুরের মাহিগঞ্জ তাজহাটের অনিন্দ্যসুন্দর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন জমিদার বাড়িটিও। এই জমিদার বাড়ির সিঁড়ি শ্বেতপাথরের, যা ইতালি থেকে আনা হয়েছিল। সিঁড়িটি নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। সময়ের বিবর্তনে এই জমিদারবাড়িটি সুপ্রিমকোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে এটি রংপুর জাদুঘর।
এবার একটু ভিন্ন ধরনের বিনোদন পেতে ছুটে চলুন পাগলাপীর বাজার থেকে একটু দূরে গঞ্জিপুর এলাকার ভিন্নজগতে। না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেন না, ভিন্নজগতের ভেতরে আরেকটি ভিন্নজগত রয়েছে। সবুজের সমারোহে ঘেরা এ বিনোদন স্পট। এখানে রয়েছে সৌরজগৎকে জানতে দেশের প্রথম প্ল্যানেটারিয়াম। আজব গুহা ছাড়াও রয়েছে তাজমহল, মস্কোর ঘণ্টা, আইফেল টাওয়ার, চীনের প্রাচীর। চলছে ট্রেন, উড়তে চাইছে উড়োজাহাজ। শিশুদের বিনোদনেরও কমতি নেই। দিনভর হইহুল্লোড় মেতে উঠতে পারেন। ক্লান্তি আসবে না। নিরিবিলি সময় কাটাতে এখানে আবাসন সুবিধাও রয়েছে।
নগরীর নিসবেতগঞ্জ ঘাঘট নদের তীর ঘেঁষে রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘প্রয়াস’ বিনোদন পার্ক। পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে বাজবে। এই পার্কের পাশেই রয়েছে ‘রক্তগৌরব’ নামের স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ অঞ্চলের জনগণ লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে অনেকে নিহত হন। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে এখানে এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে। এটিও একনজর দেখে নিতে পারেন।
বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের কাছেই রয়েছে চিকলি বিল। আর এই বিলের ধারের একপ্রান্তে চিকলি সিটি বিনোদন পার্ক, আরেকপ্রান্তে চিকলি ওয়াটার পার্ক। সেখানে বিভিন্ন রাইডে চড়ে লেকের সৌন্দর্য্য উপভোগ করুন। স্পীডবোর্ডে করে বিলের বুকে দূরন্তপনায় মেতে উঠতে মানা নেই। সেখান থেকে বেরিয়ে পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছের রংপুর চিড়িয়াখানায় যেতে পারেন। এখানে আসলে গাছগাছালির নিবিড় পরিবেশে দেখতে পাবেন পশুপাখি।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতা থেকে এসে মঞ্চনাটক করে গেছেন রংপুর টাউন হলে। এই হলটিও দর্শন দিতে ভুলবেন না। নাটকের ইতিহাসের সাথে এই রঙ্গমঞ্চের সাথে জড়িয়ে আছে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। যা শুনলে গাঁ শিউরে উঠবে। কাঁদবে হৃদয়। এই টাউন হলটি দাঁড়িয়ে আছে রংপুরের সংস্কৃতিপল্লীতে। এখানে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য চর্চাকেন্দ্র ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ’। রয়েছে পাবলিক লাইব্রেরী, অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন শিল্পকলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিসহ বিভিন্ন নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এই রংপুরে রয়েছে শতবছরের ইতিহাসের সাক্ষী দুটি প্রাচীন বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ ও রংপুর জিলা স্কুল। যার দিগন্তজোড়া খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ালে মনটা জুড়িয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও আগে প্রতিষ্ঠিত কারমাইকেল কলেজে দেখতে পাবেন শতবর্ষী বিরল কাইজেলিয়া বৃক্ষটি। এর পাশেই রয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এটি একনজরে দেখে নিতে পারেন।
এবার দেখে আসুন এমন স্থানে, যা ইতিহাসের অমর সাক্ষী হয়ে আছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় রংপুর অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি গ্রাম। পলাশীর যুদ্ধের পর যে বীরপুরুষ রংপুর অঞ্চলকে ঘিরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন, তিনি নুরউদ্দিন বাকের জঙ্গ। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের সেই নূরলদীনই হলো নুরউদ্দিন বাকের জঙ্গ। ফুলচৌকি গ্রামে তার র্কীর্তি আজও বহমান। ঐতিহাসিক সেই ফুলচৌকি গ্রাম ঘুরে যেতে ভুলবেন না।
এর পাশের এলাকা পীরগঞ্জে রাজা নীলাম্বরের জলমহাল এলাকাও ঘুরতে পারেন। কয়লা ও লোহার খনি সমৃদ্ধ পীরগঞ্জ। এখানে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরামাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার কবর। আরো রয়েছে বিনোদনস্পট আনন্দ নগরসহ কবি হেয়াত মাহমুদের সমাধি, মনোমুগ্ধকর বিশাল বিল ও সাড়ে তিনশ বছরের একটি প্রাচীন বৃক্ষ ।
ইতিহাসের আরেক অধ্যায় বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি তিব্বত অভিযানে রংপুরে একটি এলাকায় রাত্রিযাপন করার কারণে তারই নামানুসারে গ্রামের নাম হয়েছে বখতিয়ারপুর, যা রংপুর শহরের পাশেই অবস্থিত। এখানে পদধূলি দিতে ভুলবেন না।
এছাড়াও রংপুর নগরীর প্রধান সড়কে দেখা মিলবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভাস্কর্য। জিলা স্কুল মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, ধাপ চেকপোস্টে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ বিজয়, নিসবেতগঞ্জে রক্ত গৌরব, মর্ডাণ মোড়ে অর্জন, শাপলা চত্বরে ভাসমান শাপলা, পায়রা চত্বরে শান্তির প্রতীক পায়রা, লালবাগ মোড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কালেক্টরেট সুরভি উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের নামফলক।
রংপুরে বেড়াতে বেড়াতে সময় হাতে থাকলে এবার এখান থেকেই দিনে দিনে ঘুরে আসতে পারেন গঙ্গাচড়ার মহিপুর ঘাট। বিশাল তিস্তা নদীর বুকে নির্মিত দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতুর ওপারে গেলে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের কাকিনায় পেয়ে যাবেন নন্দিত কবি ফজলুল হকের বাড়ি ও সমাধি। রয়েছে কাকিনার জমিদার বাড়ি। এখান থেকে সময় করে যেতে পরেন দিনাজপুরের রামসাগর দিঘি, কান্তজিউ মন্দির, রাজবাড়ী। নীলফামারীর নীলসাগর ও তিস্তা ব্যারেজ। আরও একটু উত্তরে গিয়ে দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত তেঁতুলিয়া।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে