আজ নোয়াখালীর মাটিতে উড়েছিল লাল সবুজের বিজয় নিশান
আজ ৭ ডিসেম্বর, নোয়াখালী মুক্ত দিবস। এ দিন জেলা শহরের মাইজদী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি দখলের মধ্যদিয়ে নোয়াখালীর মাটিকে মুক্ত করে লাল সবুজের বিজয় নিশান উড়িয়েছিল মুক্তিসেনারা।
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা বিএলএফ প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ও ২ নম্বর সেক্টরের নোয়াখালীর সি-জোনের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারেফ হোসেনের নেতৃত্বে জেলা শহর মাইজদীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা।
একযোগে তারা তিনটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধের মুখে অবস্থা বেগতিক দেখে নোয়াখালী পিটিআইর ট্রেনিং সেন্টার থেকে তড়িঘড়ি করে পালিয়ে যায় খান সেনারা। হামলায় দিশেহারা হয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তিনিদের এদেশীয় দালাল রাজাকাররা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় এক মাস নোয়াখালীকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতিটি বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনারা ২৩ এপ্রিল নোয়াখালী জেলা শহরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কয়েক দফায় সদরের সোনাপুর, শ্রীপুর, গুপ্তাংক, রামহরিতালুক, বেগমগঞ্জের কুরীপাড়া, গোপালপুর ও আমিশাপাড়ায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা করে প্রায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে। গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান।
এরপর পাক-হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে মাঠে নামে দেশের অভ্যন্তরে ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধারা। কোম্পানিগঞ্জের বামনী, তালমাহমুদের হাট, ১২ নং স্লুইস গেট, সদরের উদয় সাধুর হাট (ওদারহাট), করমবক্স, বেগমগঞ্জের ফেনাকাটা পোল, রাজগঞ্জ, বগাদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা।
নোয়াখালীকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত, ঠিক তখন (৬ ডিসেম্বর) গভীর রাতে মাইজদী পিটিআই ও বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাইস্কুল ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের উদ্দেশে পালিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। এ সময় সুবেদার লুৎফুর রহমান ও শামসুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বেগমগঞ্জ- লাকসাম সড়কের বগাদিয়া ব্রিজ অতিক্রম করে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর হামলা করে। এসময় অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
মুক্ত দিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জেলা বিএলএফ প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নভেম্বর মাস থেকে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আমাদের আক্রমণের ফলে টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর গভীর রাত থেকে বিভিন্ন ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে পাক সেনা ও মিলিশিয়ারা। ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত অপারেশন শুরু হয়। সকাল আটটার মধ্যেই বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলের রাজাকার ক্যাম্প, মাইজদী কোর্ট স্টেশন, জিলা স্কুল, দত্তের হাটের নাহার মঞ্জিল মুক্ত করা হয়।
মাহমুদুর রহমান বেলায়েত আরও বলেন, ৭ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে রাজাকারদের প্রধান ও সর্বশেষ ঘাঁটি মাইজদীর পিটিআই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। টানা কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে এ ঘাঁটিরও পতন হয়। এভাবেই এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় নোয়াখালী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোশারেফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সি-জোনে মোট ১৩টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের সবগুলো যুদ্ধই সফল হয়েছে। তখন নোয়াখালীতে রাজাকার বেশি ছিল। পাক বাহিনীর থেকে রাজাকাররা আমাদের বেশি ঝামেলা করতো। আমরা সর্বশেষ ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করেছি। তার আগের দিন ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আর্মি নোয়াখালী ছেড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। মূলত রাজাকারদের পতন ঘটিয়ে নোয়াখালী মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়া মো. শাহাজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ এখন সময়ের দাবি। যদি নামকরণ করা হয় তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাল-সবুজের পতাকা অম্লান রাখতে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আর যারা সহযোদ্ধা ছিলেন তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। বরাবরের ন্যায় এবারেও নানা আয়োজনে পালন হবে নোয়াখালী মুক্ত দিবস।
হাসিব আল আমিন/এসএম