নিজের অভিজ্ঞতায় বদলে দিলেন ৪৮ নারীর জীবন
ছোটবেলায় বিয়ে হওয়ার পর ১৮ বছর পার হয় সংসারজীবনের। কিন্তু ২০১৫ সালে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে নানা সমস্যার কারণে স্বামীকে তালাক দেন। তারপর পথচলা শুরু করেন একলা। বীণা রানী ত্রিপুরা। সংসার শেষ হওয়ার পর সমাজে চলতে গিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। তবু হাল ছাড়েননি। নিজেকে যোগ্য করে তুলেছেন সমাজের মানুষের সব প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে। ‘সংসার ভাঙা এক সফল নারী’ আজ বীণা রাণী ত্রিপুরা।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন নতুন জীবন। ব্যর্থতা দিয়ে নয়, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করছেন সমাজের কাছে। তাই খাগড়াছড়ির অধিকাংশ নারীর কাছে পরিচিত ও সফল-সংগ্রামী নারী বীণা রানী ত্রিপুরা।
খাগড়াছড়ি শহরের কাছাকাছি খাগড়াপুর গ্রামে তার জন্ম। বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আর মা গৃহিণী। বেড়ে ওঠা খাগড়াপুরেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মা-বাবার ইচ্ছাতেই বিয়ে করেন। এরপর স্বামীর সংসারে পা রাখেন বীণা ত্রিপুরা। সে সুখ বেশি দিন কপালে সইল না। বাবার মেয়ে ফেরত এলেন বাবার কাছে।
দিগবিদিক চিন্তা করে বীণা ত্রিপুরা সংসার ভাঙার পর দুই সন্তান নিয়ে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে খাগড়াপুরের এক মাসির সহযোগিতায় যুব উন্নয়ন অধিদফতরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ শেখেন। ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ শেষ করে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সঙ্গে মাসির দেওয়া কিছু অর্থ দিয়ে ‘হেমি টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা আর পরিশ্রমের সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন নিজ জীবনে এবং অন্যদের জীবনে। তাই দীর্ঘ তিন বছর পর ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পেয়ে যান জয়ীতা পুরস্কার।
ঢাকা পোস্টকে বীণা রানী ত্রিপুরা বলেন, জীবনে চলার পথে সমাজের প্রায় সব মানুষের মুখেই নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা শুনতে শুনতে এগিয়ে গেছি। এ সমাজ প্রকৃত অর্থেই নারীদের জন্য বৈরী। এখন আমাকে নিয়ে কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করে না। নিজে ভালো আছি, অন্য অনেক নারীকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
শুধু উদ্যোক্তা হিসেবেই সফল নন বীণা। সন্তানদেরও করে তুলছেন শিক্ষিত। একমাত্র মেয়ে হেমী ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি পুলিশ লাইন্স স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। ২০১৬ সালে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে সে। পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকেও কৃতিত্বের সঙ্গে বৃত্তি পেয়েছে সে। আর একমাত্র ছেলে অর্কিড ত্রিপুরা ঢাকায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে।
এদিকে খাগড়াপুরে প্রতিষ্ঠা করা হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বীণা ত্রিপুরা নিজেই ঘুরে দাঁড়াননি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এ রকম অসংখ্য অসহায় নারী। এ পর্যন্ত ৪৫ থেকে ৫০ জন নারী তার প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শিখে তারাও তাদের পরিবারকে এনে দিচ্ছেন বাড়তি আয়, সচ্ছলতা।
জানা যায়, এই নারীদের কেউ শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়া, কেউ হতদরিদ্র, কেউ স্বামী-পরিত্যক্তা। খাগড়াছড়ি তৈইবাগলাই, গাছবান, ধর্মঘর, ইসলামপুর, কুমিল্লা টিলা, বড়পাড়া, সাজেক লংটিয়ান পাড়াসহ আরও অনেক জায়গা থেকে এসে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারাও আজ একেকজন সফল উদ্যোক্তা।
তাই তো অসহায় নারীদের কাছে বীণা রানী আজ পরিচিত। তার মাধ্যমে অনেক নির্যাতিত ও অসহায় নারী এখন আলোর পথ দেখছেন সহজভাবে। ঋণ নিয়ে হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার শুরু করার পর থেকে এখন তিনি প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। তার সঙ্গে কাজ শিখে এখন অনেক নারী নিজের মতো করে অর্থ উপার্জন করছে।
বীণা রানী থেকে কাজ শিখে উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করছেন মাচালং থেকে আসা পহি রানী ত্রিপুরা। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, আমি তার বাসায় থেকে তাকে কোনো টাকাপয়সা না দিয়ে কাজ শিখেছি। এখন আমি সম্পূর্ণ কাজ নিজে করতে পারি। আমি উদ্যোগ নিয়ে বাড়ির পাশে একটি দোকান দিয়েছি। এখন সফলতার মুখ দেখছি।
বীণা রানী ত্রিপুরা এই পর্যন্ত ১২ জনকে নিজের বাসায় রেখে ভরণপোষণ দিয়ে কাজ শিখিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তারা এখন নিজের এলাকায় গিয়ে দোকান দিয়ে কাজ করছেন এবং অনেকে বাসায় সেলাই মেশিন দিয়ে অর্ডার নিয়ে কাজ করছেন।
সাজেক থেকে কাজ শিখতে আসা রানী ত্রিপুরা বলেন, আমি এখানে কাজ শিখতে আসছি। আমার কোনো খরচ দিতে হয় না। তার বাসায় থেকে কাজ শিখতেছি। ভরণপোষণ বহন করেন তিনি। আমি এখান থেকে কাজ শিখে দুর্গম সাজেকে একটি দোকান দেওয়ার চেষ্টা করব। যাতে নিজের মতো করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ধর্মঘর থেকে আসা ওয়েটলি চাকমা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে এই সময়টাতে আমি প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে এসে এখানে কাজ শিখি। এতে তাকে আমার কোনো টাকা দিতে হয় না। বিনা টাকায় তিনি কাজ শেখান আমাকে। এই কাজ শিখে বাড়িতে বসে নিজের কাজের পাশাপাশি অর্ডার নিয়ে সেলাই কাজ করতে পারব।
হেমী টেইলার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার থেকে কাজ শিখেই নিজের কাজের পাশাপাশি আয়ের পথে হাঁটছেন অসংখ্য নারী। তারা এখানে কাজ শিখে নিজের ঘরে সেলাই ছাড়াও অর্ডার পাচ্ছেন পাড়া-প্রতিবেশীরও। এতে নিজের চলার হাত খরচ জোগাতে তেমন বেশি কষ্ট পোহাতে হয় না।
কয়েক বছরে সংগ্রাম করে সব বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন ‘জাতীয় যুব পদক ২০১৮’, যা তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে জানিয়েছেন বীণা রানী। এ ছাড়া ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জয়িতা।
বীণা রানী বলেন, এই পর্যন্ত অনেক নারীকে কাজ শিখিয়েছি। ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি শেখানোর চেষ্টা করছি। ১২ জন নারী এখন উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন এলাকায়। আরও অনেকজন বাসায় নিজের কাজের পাশাপাশি অর্ডার নিয়ে কাজ করে নিজের হাত খরচ চালাই। সমাজের বঞ্চিত নারীদের সেলাইয়ের কাজ শেখানোর জন্য আমার দুয়ার খোলা। আমি সব অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের কাজ শেখানোর জন্য পাশে থাকব।
তিনি আরও বলেন, এখনকার সমাজে সংসারের পাশাপাশি সব নারীই যেন নিজের কর্মক্ষমতাকে শাণিত করেন ‘শুধু স্বামী অথবা অন্যদের ওপর নির্ভরতার বাইরে বিকল্প ক্ষেত্র থাকা উচিত। তবেই পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং মর্যাদার ভারসাম্য টিকে থাকবে। সাহস, সততা, শক্তি ও দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে দিন কার জন্য আটকে থাকে না।
খাগড়াছড়ি জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে দিয়ে নিজেকে নতুন উদ্যমে মানুষের কাছে পরিচিত করতে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন বীণা রানী ত্রিপুরা। তিনি তার দোকানে অসহায়, সহায়সম্বলহীন ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীদের দরজিকাজের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার কাছ থেকে দরজিকাজ শিখে অনেকে নারী উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। তারা এখন নিজের মতো করে কাজ করে চলতে পারেন এবং সংসারে বাড়তি অর্থ জোগান দিয়ে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারেন।
এনএ