অবহেলিত সেই গ্রাম এখন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ, শুঁটকিপল্লী নামে খ্যাত
এক সময়ের অবহেলিত লালপুর ইউনিয়ন এখন অথনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক জনপদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের চরলালপুর গ্রামটিকে দেশজুড়ে পরিচিতি দিয়েছে শুটকি। গ্রামটিকে এখন শুঁটকিপল্লী হিসেবেই বেশি চেনে মানুষ। এছাড়া ভারতেও রপ্তানি হয় শুটকিপল্লীতে তৈরি পুঁটি শুঁটকি। প্রতি বছর এ পল্লী থেকে অন্তত ১০০ কোটি টাকার দেশীয় মাছের শুঁটকি বাজারজাত করা হয়। তবে পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকায় ব্যবসাটিকে বড় করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালপুর ইউনিয়নে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। কয়েক দশক আগেও এই ইউনিয়ন ছিল অবহেলিত। এখানকার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। কৃষিকাজ ও মেঘনা নদীতে মাছ ধরাই ছিল স্থানীয়দের জীবন ও জীবিকা। তবে এখন লালপুরের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে চরলালপুর গ্রামের শুঁটকিপল্লী। এছাড়া এখন প্রবাসী রেমিট্যান্সও আসে লালপুর ইউনিয়নে।
তবে গেল দুই বছর করোনার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চরলালপুরের শুঁটকি কারবার। করোনার প্রথম বছরে ব্যবসা না হওয়ায় মজুদ করা শুঁটকি নষ্ট হয়ে অন্তত ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় বছরেও ভালো ব্যবসা হয়নি। তবে এবার করোনার সংকট কাটিয়ে ভালো ব্যবসার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরলালপুর গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী আছেন তিন শতাধিক। এ ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় কয়েকশ নারী-পুরুষের। এখানে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের শুঁটকি তৈরি হয়। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মাছ সংগ্রহ করে পুরোদমে চলে শুঁটকি তৈরির কার্যক্রম। এ সময় শুঁটকি তৈরির পাশাপাশি মজুতও করেন ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে চরললাপুর গ্রামের মেঘনা নদীর পাড়ে চলছে মাছ থেকে শুঁটকি তৈরির কর্মযজ্ঞ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ এনে প্রক্রিয়াজাত করে শুকানো হয় মাচা বা ডাঙ্গিতে। ৫০-৬০টি ডাঙ্গিতে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। দেশের বিভিন্নস্থানে বাজারজাতের পাশাপাশি ভারতে রপ্তানি হয় পুঁটি শুঁটকি। এখানে তৈরি হওয়া শুঁটকির ৫০ শতাংশই পুঁটি।
বর্তমানে লালপুর শুঁটকিপল্লী থেকে আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি পুঁটি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ও ট্যাংরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০-৭০০ টাকা দরে। শোল মাছের শুঁটকি ১০০০-১২০০ টাকা, বাইম শুঁটকি ১৫০০-১৭০০ টাকা, কাইক্কা ১০০০-১২০০ টাকা, গইন্না ৫৫০-১০০০ টাকা এবং রুই শুঁটকি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দামে।
কয়েকজন শুঁটকি ব্যবসায়ী জানান, ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে শুঁটকি ব্যবসার জন্য ঋণ সুবিধা পান না। এর ফলে বিভিন্ন সমিতি ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। ফলে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করে ব্যবসা থেকে তেমন লাভ হয় না। তাই শুঁটকি ব্যবসাকে আরও বড় করার জন্য সকল ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ কিংবা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার দাবি জানান তারা।
লালপুর গ্রামের বাসিন্দা বাকের আহমেদ খান জানান, একটা সময় কৃষি কাজ করেই আমাদের গ্রামের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। এখন প্রবাসী র্যামিটেন্সের পাশাপাশি শুঁটকি ব্যবসা থেকে ভালো টাকা আসছে। এই শুঁটকিপল্লী লালপুরকে সারাদেশে পরিচিত করেছে।
শুঁটকিপল্লীর ব্যবসায়ী সুকমল দাস জানান, বর্তমানে তার ডাঙ্গিতে ১৫ লাখ টাকার শুঁটকি আছে। এগুলো বিক্রির পর আবারও মাছ কিনে শুঁটকি তৈরি করবেন। প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি করেন তিনি। তবে পুঁজির সংকটের কারণে ব্যবসা বড় করতে পারছেন না। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সুমন দাস নামে আরেক শুঁটকি ব্যবসায়ী জানান, শুটকি ব্যবসায় তাদের গ্রামের অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই ব্যবসা তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী করেছে। তবে গেল দুইবছর ব্যবসা করোনার কারণে খারপ গেলেও এবার ব্যবসা ভালো হবে বলে আশা করছেন।
নিখিল দাস বলেন, শুঁটকিপল্লীতে কয়েকশ নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। কেউ মাছ ধোয়ার কাজ, কেউ আবার মাছ কাটে। এ ব্যবসায় শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে, তবে গেল কয়েক বছর ধরে নদী ও খাল-বিলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে কম। এর ফলে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচা মাছ পাওয়া যায় না। এতে করে মাছের দাম বেশি পড়ায় শুঁটকি তৈরিতে খরচ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এর প্রভাব পড়ছে শুঁটকির দামে।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরবিন্দ বিশ্বাস বাপ্পি বলেন, শুঁটকিপল্লীতে আমরা ব্যবসায়ীদের জন্য পল্লী উন্নয়ন ও যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা করেছি। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকে। এছাড়া শুঁটকি শুকাতে ড্রয়ার মেশিনের জন্য আমরা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছি। শুঁটকি ব্যবসার অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই আমরা নিচ্ছি।
বাহাদুর আলম/আরকে