ডিলারের দুর্নীতির মাশুল গুনছেন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগীরা
দুর্নীতি-অনিয়ম ও ভুয়া তালিকা তৈরি করে সরকারের দেয়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রির অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের এক ডিলারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কার্ড অনলাইনে নিবন্ধন করতে দিয়ে একই পরিবারে একাধিক কার্ড থাকার বিষয়টি ধরা পড়েছে। নামে-বেনামে ভুয়া তালিকা তৈরি করে বিভিন্ন সময় কার্ড তৈরি করায় এখন অনেক সুবিধাভোগী খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড নিবন্ধন করতে পারছেন না।
জানা যায়, শাহজাহানপুর ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির চালের ডিলার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের ছেলে মো. সেলিম রেজা দুলাল এই দুর্নীতির সাথে জড়িত। তিনি গত ৫ বছর ধরে এমন অন্তত দেড় শতাধিক কার্ডের চাল তুলছিলেন। পরে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেবাকেন্দ্রে অনলাইনে নিবন্ধন করতে গেলে তা ধরা পড়ে। একাধিক কার্ড থাকায় নিবন্ধন হচ্ছে না অনেক সুবিধাভোগীর খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড। এ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সুবিধাভোগীদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ ছেলের নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির ডিলারশিপ পাইয়ে দেন সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম। নামে-বেনামে ভুয়া তালিকা করে কার্ডে বানিয়েছেন তার ছেলে ডিলার সেলিম রেজা দুলাল। এমনকি তালিকায় একাধিক কার্ডে নিজেদের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে সেই চাল তুলে বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকা থেকে প্রমাণ মিলেছে। বিভিন্ন পরিবারে একটি কার্ডে বছরের পর বছর চাল ভোগ করেছেন, কিন্তু তালিকাভুক্ত পরিবার বিষয়টি জানতেনই না।
এ অনিয়মের বিরুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় সুবিধাভোগী নুরুজ্জামান বকুল। প্রতিকারের অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. তরিকুল ইসলাম ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যসহ পাঁচ ইউপি সদস্য।
জানা যায়, সম্প্রতি সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন তালিকাভুক্ত করার নিয়ম চালু করেছেন। সেখানে প্রায় ১৫৬টি কার্ডের কোনো হদিস মেলেনি। এছাড়াও নিজেদের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অনেক নামের তালিকা দিয়ে নিজেরাই সুবিধা ভোগ করছেন খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির ডিলার সেলিম। অন্যদিকে, একই পরিবারে ২-৩টি এবং একাধিক খাদ্যবান্ধব কর্মসুচির কার্ড দিয়েছেন। এতে বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত অসহায়-দরিদ্র পরিবারগুলো।
জানা যায়, শাহজাহানপুর ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচীর তালিকায় মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১২৩৯ জন। এর মধ্যে শাহজাহানপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডেরই প্রায় ১৭৯ জনের মধ্যে ১৯ জনের ভুয়া নাম এবং মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
শাহজাহানপুর ইউনিয়নের জহরুল (কার্ড নম্বর-৬৪), তার স্ত্রী ( ১৬১) ও মেয়ে সুমাইয়া (১৬৪) এর নামে একই বাড়িতে ৩টি কার্ড রয়েছে। এছাড়াও চেনুয়ারা (কার্ড-৬৭) ও তার স্বামী সফিকুল (৬৮) একই বাড়িতে ২টি, বেলাল (৮৩) ও তার স্ত্রী এবং উত্তরা খাতুন ও স্বামী ফেকন (১৪২) এর নামে একাধিক কার্ড রয়েছে। অথচ তারা এতোদিন একটি কার্ডের চাল পেয়েছেন। এছাড়াও একই বাড়িতে স্বামী আজাদ আলী (২১) ও তার স্ত্রী (১১৭৪), রুপসী (৮৫) ও স্বামী জিয়ারুলের নামে কার্ড তৈরি করা হয়। এমনকি ফাতেমা ও তার প্রকৃত স্বামী ও স্বামীর নাম পরিবর্তন করে (পরিবর্তিত নাম রুহুল আমিন ১৬৫) একই বাড়িতে ৩টি কার্ড করে ২টির চাল তুলতেন ডিলার দুলাল৷
রূপসী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের ছেলে ডিলার সেলিম রেজা দুলাল ৫ বছর আগে আমার ও স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে যায়। তার কয়েকদিন পরে বাড়িতে এসে আমার নামে একটি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড দিয়ে গেলে তা দিয়ে গত ৫ বছর ধরে চাল তুলে খাই। সরকার নতুন নিয়ম করেছে কার্ডের অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদে নিবন্ধন করতে গেলে তারা জানায়, আমার স্বামীর নামে আরেকটি কার্ড রয়েছে, তাই নিবন্ধন হবে না। তখন জানতে পারলাম, আমার স্বামী ও আমার নামে দুইটি কার্ড ছিল৷ একটি ডিলার নিজেই এতোদিন ভোগ করেছেন।
নরেন্দ্রপুর পশ্চিমপাড়ার বেলাল হোসেন জানান, আমাদের পরিবারেও দুইটি কার্ড ছিল, তা অনলাইনে নিবন্ধন করতে গিয়ে জানতে পেরেছি। অথচ আমাদেরকে এতদিন ধরে একবারও বলেনি। ডিজিটাল সেবা কেন্দ্র থেকে আমার মতো অনেক মানুষই ঘুরে যাচ্ছে নিবন্ধন না হওয়ার কারণে। এমন অনেক পরিবারের নামে দুইটি করে কার্ড থাকলেও একটি সুবিধাভোগী পরিবারকে দিয়ে আরেকটির চাল তুলেছেন ডিলার সেলিম রেজা দুলাল।
শাহজাহানপুর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. সাদিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কোনো তালিকা অনলাইনে নিবন্ধিত ছিল না। সরকারের নতুন নির্দেশনায় অনলাইনে নিবন্ধন কাজ চলছে। কিন্তু এমন অনেক সুবিধাভোগীর একই পরিবারে একাধিক কার্ড থাকায় তাদের নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই তাদেরকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।
চেয়ারম্যান মো. তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসুচীর ডিলার সেলিম রেজা দুলাল কয়েকবছর ধরেই ১৫৬টি কার্ডের চাল নিজেই তুলছেন। এতে ইউনিয়নের প্রকৃত অহসায় দরিদ্র পরিবারগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি এবং এসব কার্ড বাতিল করে প্রকৃত অসহায় পরিবারকে কার্ড দেয়ার দাবি জানিয়েছি।
এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চাননি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ও তার ছেলে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার সেলিম রেজা দুলাল৷ তবে ডিলার সেলিম রেজা দুলাল জানান, চাল বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া কার্ড অনুযায়ী সুবিধাভোগীদের মাঝে চাল বিতরণ করেছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাইমা হক জানান, শাহজাহানপুর ইউনিয়নে একই পরিবারে একাধিক কার্ড দেওয়া ও ডিলারের চাল আত্মসাতের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে৷ তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷
মো. জাহাঙ্গীর আলম/আরকে