সাবেক সার্ভেয়ার শত কোটি টাকার মালিক, দুদকে অভিযোগ
বিরোধপূর্ণ জমির সন্ধান পেলে নিজেই তদবির করে নিয়ে নেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি। এরপর প্রভাবশালীদের নিয়ে সেই জমি দখলে নেন। আর এভাবে নামে-বেনামে শত কোটি টাকার সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন এমএ মোতালেব হাওলাদার নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত একজন সার্ভেয়ার।
শুধু পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়েই ক্ষান্ত নয়, হামলা-মামলার মতো ধারাবাবিক কাজও তিনি করেন জমি দখলে নিতে। এভাবে শতকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ওই সার্ভেয়ারের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন এক ভুক্তভোগী।
অভিযুক্ত এমএ মোতালেব হাওলাদার বরিশাল মেট্রোপলিটন এয়ারপোর্ট থানার বাঘিয়া এলাকার বাসিন্দা। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য নয়। বরং তার জমি প্রতিপক্ষ দখলে নিতে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিচ্ছে।
ওয়ারিশসূত্রে জমি পেয়েছেন কাশিপুর এলাকার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের। কিন্তু পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সেই জমি দখলে নিতে পারছেন না সার্ভেয়ার মোতালেবের কারণে। তিনি বলেন, মোতালেবের সঙ্গে আমাদের ৩ একর ৪০ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধ। এই জমি আমরা ওয়ারিশসূত্রে পেয়েছি। কিন্তু তিনি ১৯৬০/৬১ সালের একটি নিলামে পেয়েছেন মর্মে জমি তার দাবি করে আসছেন। এ নিয়ে মামলা চলছে। অথচ তিনি যে নিলামের দাবি করছেন জেলা প্রশাসনের রেজিস্ট্রি অফিসে নিলামের ওই আদেশনামা বা আদৌ নিলাম হয়েছে বলে কোনো তথ্য নেই। একটি ভুয়া নিলাম তৈরি করে জমি তার দাবি করছেন।
তিনি বলেন, শুধু আমি নয়, কাশিপুর এলাকায় এভাবে অনেক লোকের জমি প্রতারণা করে নিজের নামে নিয়েছেন মোতালেব। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আজ পথে বসেছেন তার কারণে। মোতালেব সার্ভেয়ার। এজন্য বরিশালের আশপাশের সকল জমির খবর জানেন। যেখানে গিয়ে দেখেন জমি মূল্যবান, সেখানেই নিজে কায়দা করে ঢুকে বিরোধ তৈরি করেন। আর জমির মালিক দুর্বল হলে সেই জমি নিজের নামে লিখে নেন।
আলেকান্দার বাসিন্দা সৈয়দ সাবের হোসেন বাবু বলেন, আমি প্রবাসে ছিলাম। ৩০ বছর পর দেশে এসে আমার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিরও দখলে নিতে পারছিলাম না। মোতালেব কোথা থেকে জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে আমাকে মামলায় জড়িয়ে দিল। এখন নিজের জমির জন্য তার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, মোতালেবের টার্গেট থাকে নগরীর কোন কোন স্থানে দামি জমি রয়েছে। জমির মালিক যদি বিদেশে থাকেন বা একটু দুর্বল হন তাহলে জাল কাগজ তৈরি করে সেই জমি নিজের দাবি করেন। শুধু আলেকান্দা নয়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তিনি জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে মামলা চালিয়ে অনেককে নিজের জমিতেও যেতে দিচ্ছেন না।
মোতালেব হাওলাদারের হয়রানির শিকার হয়ে জমি হারাতে বসেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মীরা বাড়ির বাসিন্দা সৈয়দা ইসমাত সায়লা। বাবা অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের মো. শফিউল্লাহ তার ও বোনের নামে যে জমি লিখে দিয়েছেন সেই জমিরও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে দখলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মোতালেব হাওলাদার। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে ৭ আগস্ট অভিযোগ দিয়েছেন অসহায় ওই নারী। অভিযোগটি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
সায়লা বলেন, আমার বাবা যে জমির মালিক ছিলেন সেই জমি আমাদের দুই বোনের নামে লিখে দেন ২০১৭ সালে। অথচ মোতালেব সার্ভেয়ার ২০২২ সালের জুলাই মাসে সেই জমিতে তার নামে সাইনবোর্ড দিতে আসেন। সঙ্গে অনেক গুন্ডা-সন্ত্রাসী নিয়ে আসেন। তিনি এভাবেই নগরীর অনেক মানুষকে পথে বসিয়েছেন। যেহেতু তিনি সার্ভেয়ার, সেজন্য নগরী ও আশপাশের জমি নিয়ে খুটিনাটি জানেন। আমরা জমির মালিক সকলেই নারী। আরা যেখানের জমির মালিক আমরা সেই জমির দাম কয়েক কোটি টাকা। এই লোভে কোথাকার একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে এসে দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মোতালেব আমার ভাইকে গুম করারও হুমকি দিয়েছেন। আমরা পুরো পরিবার নিয়ে সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি- কখন মোতালেব সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে আমাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেন। তার দাবি, স্থানীয় প্রশাসন তাদের কোনো সহায়তা করছে না। আইনের আশ্রয় নিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
সৈয়দ বরকত হোসেন বলেন, মোতালেব হোসেনের লক্ষ্যই হচ্ছে দামি জমিতে তৃতীয় কোনো পক্ষ দাঁড় করিয়ে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেওয়া। তারপর সেখানে তিনি সব রকমের হামলা-মামলা করে দখলে নিতে চান। শুধু আমি না, নগরীর অনেকেই সার্ভেয়ার মোতালেবকে নিয়ে আতঙ্কে থাকেন।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত সার্ভেয়ার এমএ মোতালেব হোসেন। তিনি বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তারা আমার আত্মীয় নন। তবে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা আমার জমি জাল-জালিয়াতি করে দখলে নিতে চায়। এজন্য শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনে নয়, দেশের অনেক দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। সেই অভিযোগের সূত্র ধরে আমাকে বরিশাল মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা অফিস ডেকেছিল। আমি সেখানে আমার জমির কাগজ দেখিয়ে এসেছি। পুলিশ কমিশনার স্যারের সঙ্গে দেখা করে জমির কাগজ দেখিয়ে এসেছি। এই সংঘবদ্ধ দলটি আমাকে হয়রানি করছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে থাকায় এখনো বরিশাল অফিসে এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের চিঠিপত্র শাখার আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, দেশের স্বনামধন্য একটি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন সার্ভেয়ারের দায়িত্ব পালনের পর সেখান থেকে এমএ মোতালেব হাওলাদার চাকরিচ্যুত হন বলে জানা গেছে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর